পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনিক শ্রেণীর হাতে সম্পদ পুঞ্জীভ‚ত হয়। এতে সামাজিক বৈষম্য বাড়তে থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে ‘সর্বহারাদের রাজ’ কায়েমের নামে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র গরিব ও বিত্তহীনদের বিদ্রোহে উৎসাহিত করে। যদিও সমাজতন্ত্রের আবেদন আগের মতো আর নেই। যাই হোক, পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট বিপ্লবের মতো ‘অঘটন’ যাতে পশ্চিম ইউরোপেও না ঘটে সে জন্য পুঁজিবাদের সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণের ব্যাপারে রাষ্ট্রের মুখ্য ভ‚মিকা পালনের ধারণা থেকে পাশ্চাত্যে কল্যাণ রাষ্ট্রের উদ্ভব। কল্যাণ রাষ্ট্র মূলত নিজের সুবিধাবঞ্চিত নাগরিক বিশেষ করে গরিব, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও বেকারদের কল্যাণে প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। এসব নাগরিক যাতে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রেখে বেঁচে থাকতে পারেন সেটি দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণে রাষ্ট্র যেসব কার্যক্রম নিয়ে থাকে তার মধ্যে রয়েছে- বেকার ভাতা, পেনশন, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্ব ও পরিবার ভাতা, স্বাস্থ্যবীমা প্রভৃতি। সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্ক এসব সুবিধা দেয়। ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্স একটু সীমিত আকারে হলেও এসব সুবিধা দিচ্ছে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আরো সীমিত আকারে বিভিন্ন ভাতা দেয়া হয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা চালু রয়েছে।
অন্যদিকে, সব নাগরিকের জন্য এসব রাষ্ট্র ব্যাপক মাত্রায় ভর্তুকি দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গৃহায়ন ও গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু রাখছে। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা এবং ভর্তুকি দিয়ে পরিষেবা চালু রাখার লক্ষ্যে প্রগতিশীল কর (প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্স) ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে। এ ছাড়া অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা প্রদানে সরকার সরাসরি বা নিয়ন্ত্রণমূলক ভ‚মিকা পালন করে। যেমন- সরকারি হাসপাতাল, স্কুল, পানি সরবরাহ বা পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এরূপ ব্যবস্থা রয়েছে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেমনটি দাবি করা হয়, প্রবৃদ্ধি বেশি হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ধনীদের থেকে চুঁইয়ে পড়ে (ট্রিকল ডাউন) কিছু সম্পদ গরিবদের কাছে যাবে- প্রকৃত বাস্তবতায় এমনটি যা ঘটে তা এতই কম যে, তাকে প্রহসন বলা ছাড়া উপায় নেই। নানা কারণে বাজারব্যবস্থার ব্যর্থতা অনস্বীকার্য। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা বা গৃহায়নে সরাসরি উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এরূপ দায়িত্ব পালনে সরকার আইন বা বিধিবিধান প্রণয়ন ও বিভিন্ন ধরনের সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ গঠন করে থাকে।
কল্যাণ রাষ্ট্র একটি সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নীতি ও কর্মসূচি নেয়। এর মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে এরূপ বার্তা দেয়া হয়, নাগরিকরা তাদের ‘সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখবে এবং চাহিদা অনুযায়ী সেবা পাবে।’ এরূপ নীতি বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ এবং নাগরিকদের গণশুনানির ব্যবস্থা করা হয়।
রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে সরকার বাজেট ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদারে এগিয়ে আসে। এরূপ ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের যৌক্তিকতা প্রবল হয়ে ওঠে।
পাশ্চাত্যের কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা কমিউনিজম-বিরোধী বাজার অর্থনীতির সমর্থকদের কাছে দারিদ্র্য কমাতে আশাজাগানিয়া হলেও তা অর্থনৈতিক বৈষম্য অবসানে এবং ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি সফল হয়নি। নানাবিধ সীমাবদ্ধতায় কথিত কল্যাণ রাষ্ট্র এখন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এখানে তার কয়েকটি আলোচনা করা হলো :
১. কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নানাবিধ ভাতা ও ভর্তুকি দিতে সরকারের প্রচুর পরিমাণে রাজস্বের প্রয়োজন হয়। সে জন্য আয়কর ও বিভিন্ন প্রকার শুল্ক ও কর আরোপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নাগরিক বিশেষ করে শিল্পপতি ও বিত্তশালীদের উপর উচ্চহারে কর আরোপে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। নতুন উদ্যোক্তা তৈরির গতি শ্লথ হয়ে যায়। ধনিক শ্রেণীর মধ্যে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন খাতে নিম্নবিত্তদের জন্য ভর্তুকি দেয়া হয়ে থাকে; কিন্তু এর সুবিধা লক্ষ্যীভ‚ত লোকেরা পায় না; বরং একটি স্বার্থান্বেষী মহল তার দ্বারা লাভবান হয়।
২. বিভিন্ন প্রকারের ভাতা দীর্ঘদিন ধরে পেতে থাকলে সুবিধাভোগীদের মধ্যে এক ধরনের নির্ভরতার সংস্কৃতি (ডিপেনডেন্সি কালচার) তৈরি হয়। সুবিধাভোগী নাগরিকদের মধ্যে কাজ না করার প্রবণতা দেখা দেয় এবং তাতে জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পায়, যা কোনো অর্থনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে এরূপ অনুৎপাদনশীল বেকার ভাতা গ্রহণকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
৩. মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তারা মনে করেন, বেশি মাত্রায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাজারব্যবস্থার দক্ষতা ব্যাহত করে। এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষতা, দুর্নীতি ও সম্পদের অপবরাদ্দ হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
৪. অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যসেবা ও বিভিন্ন পরিষেবার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি বাজেটের ওপর চাপ বাড়ছে। সরকার কোনোভাবে প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা কমাতে পারছে না বা সেগুলো চালু রাখতে ঋণ গ্রহণের দিকেও যেতে পারছে না।
৫. এশিয়ার জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ ও মানসম্মত খাবারে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। এতে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বয়স্কদের বিভিন্ন পরিষেবা, পেনশন ও ভাতা দিতে সরকারি বাজেটের উপর চাপ বাড়ছে।
৬. কল্যাণ রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রকার ভাতা ও সুবিধা পেতে কেউ কেউ অসাধু পন্থার আশ্রয় নিচ্ছেন। মিথ্যা ও প্রতারণার বহু ঘটনা ঘটছে। এখানে নাগরিকদের নৈতিকতার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। এর ফলে সরকারের সাধু উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়।
৭. কল্যাণ রাষ্ট্রে সুবিধাবঞ্চিতরা বিভিন্ন প্রকার ভাতা ও সুবিধা যা পান তা হয়তো ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে প্রশংসনীয়। কিন্তু বাজার অর্থনীতি যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে কল্যাণ রাষ্ট্র তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও বৈষম্য নিরসনে তা কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারে না। ফলে আমাদের দেশে হাজার হাজার পরিবার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছে; আর দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও কয়েক কোটি।
৮. সাধারণত কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক হয়। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত পার্থক্য থাকবে। সুতরাং এক সরকারের প্রবর্তিত ভাতা ও ভর্তুকির নীতিমালা আরেক সরকারের আমলে পরিবর্তিত হতে পারে। এর ফলে সুবিধাবঞ্চিতদের সুযোগ-সুবিধা কমবেশি হতে পারে। এতে সরকার যেমন সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে, তেমনি রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
৯. প্রতিটি সমাজে কিছু বেপরোয়া লোক থাকে। কোথাও বেশি, কোথাও কম। এ জাতীয় লোকেরা জানেন, যাই হোক না কেন- রাষ্ট্র তার দেখভাল করবে। তখন তারা অযৌক্তিক আচরণ করতে পারে। সরকারকে এ ধরনের লোক সামলাতে বেগ পেতে হতে পারে।
১০. কল্যাণ রাষ্ট্রে সাধারণত আয়করের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য দেশে চলে যেতে পারেন। এতে ব্যবসায়-বাণিজ্যে রাষ্ট্র প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারাতে পারে।
১১. কল্যাণ রাষ্ট্রে বিভিন্ন পরিষেবায় সরকারের অংশগ্রহণ ও ভ‚মিকা বেশি থাকায় স্বাভাবিকভাবে আমলাতন্ত্রের প্রভাব বাড়ে। অনেক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি, জনবল নিয়োগ, তাদের বেতন-ভাতা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কারণে খরচ বহুগুণ বাড়ে। তাছাড়া চিরাচরিতভাবে আমলাতন্ত্রের অদক্ষতায় পরিষেবার গতি শ্লথ হতে পারে। এর ফলে নাগরিকরা সুষ্ঠু সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
১২. যেসব কল্যাণ রাষ্ট্রে নাগরিকদের বিভিন্ন ভাতা ও সুবিধাদি দেয়া হয়, সেসব দেশে প্রবাসী গমনের হার বেশি। সরকার যদি তা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে বেকার ভাতা, গৃহায়নসহ নানাবিধ সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সাম্প্রতিককালে কানাডায় যেমনটি ঘটেছে।
উল্লিখিত সীমাবদ্ধতায় বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ কল্যাণ রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন। হ্যারি কে গিরভেজ তার ওয়েলফেয়ার স্টেট গ্রন্থে বলেছেন, ‘কল্যাণ রাষ্ট্র উদারনীতিবাদের দর্শন বা বাজার অর্থনীতির অলঙ্ঘনীয় পোশাক ছেড়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারেনি।’ মরিস ব্রুসের ভাষায়- ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা কোনো রাজনৈতিক সামাজিক চিন্তাভাবনা বা দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে জন্মলাভ করেনি; এরূপ রাষ্ট্র কোনো সুপরিকল্পিত চিন্তার ফসল নয়।’ সিডনি হুকের মতে, ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের পেছনে যে সামাজিক দর্শন তা অপরিণত ও অস্পষ্ট।’ প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল বলেন, ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের কর্মসূচিতে সরকারি হস্তক্ষেপের যে ব্যবস্থা দেখা যায় তা মতাদর্শ নয়; বরং ঘটনাচক্রের ফলশ্রুতি।’
মাইকেল নোভাকের মতে, ‘বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থময় একটি সমাজের মাথার উপর কোনো পবিত্র আচ্ছাদন নেই। এ ধরনের সমাজে কোনো আধ্যাত্মিক ইচ্ছা নেই। আধ্যাত্মিকভাবে এটি একটি শূন্য মন্দির। এ মন্দির এমন অন্তঃসারশূন্য যে, কোনো শব্দ, প্রতিবিম্ব বা প্রতীক আমাদের সবার কাক্সিক্ষত কোনো বিষয়কে মূর্ত করে তোলে না।’ প্রফেসর উমার চাপড়া বলেন, ‘সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থকে ত্যাগ করার নৈতিক চেতনা ও মূল্যবোধ এবং জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে ঐকমত্য ছাড়া আর্থ-সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় শুধু রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্রের সাহায্যে আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন এবং তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাবে বলে প্রত্যাশা করা আসলে একটি ভ্রান্তিবিলাস মাত্র। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ যা কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তিস্তম্ভ, তাতে জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে ঐকমত্য ও নৈতিক চেতনা উভয়কে অস্বীকার করা হয়েছে।’ বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানও অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়ার কথা বলে আসছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজনীতি পুরোপুরি বাজারভিত্তিক নয়; আবার এখানে ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রের কিছু উপাদান অনুসরণের চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া এখানে তথাকথিত উন্নয়ন অর্থনীতির স্লোগানও দেয়া হয়ে থাকে। উন্নয়ন অর্থনীতির প্রবক্তারা বলে থাকেন, পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশগুলোর অনুসরণে দরিদ্র দেশগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত কাঠামোর সংস্কার করা না হলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ধারণাটি বেশ প্রবল। ইউজেন স্টেলি নামে একজন স্কলার বলেছেন, ‘কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। এসব দেশকে পশ্চিমের মূল্যবোধ ও সমাজ কাঠামো গ্রহণ করতে হবে।’ তার এ বক্তব্যের জন্য তিনি বেশ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। বাস্তবে পশ্চিমের মূল্যবোধ ও সমাজ কাঠামো উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোতে কি প্রয়োগ করা সম্ভব? তা সত্তে¡¡ও আমরা লক্ষ করছি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সেক্যুলার রাজনীতিবিদ ও আমলারা অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তাদের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করছে; কিন্তু পাশ্চাত্যের উন্নয়ন মডেল আমাদের জন্য সামান্যই কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের আর্থ-সামাজিক নীতি নিজস্ব জীবনবোধ সামনে রেখে প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে পুঁজিবাদের কুফলগুলো আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রবলভাবে আঘাত করেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর উমার চাপড়ার নিম্নের উক্তিটি আমাদের জন্য প্রণিধানযোগ্য-
‘অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি বিশ্বদর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে না উঠলে মানুষ ওই ব্যবস্থার লক্ষ্য ও তা অর্জনের উপায় হতে পারে না। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক কোনো বিশ্বদর্শনে মানুষকে এ ধরনের গুরুত্ব দেয়া হয়নি এবং ডারউইনবাদ সঞ্জাত এ দর্শনে মানব ভ্রাতৃত্ববোধ, আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সম্পদের আমানতদারিতা সম্পর্কে যে অন্তর্নিহিত বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন তা স্থান পায়নি। ... এসব দর্শনে সমাজের স্বার্থে কাজ করতে মানুষকে নিয়োজিত করার কোনো উদ্বুদ্ধকরণমূলক ব্যবস্থা নেই। সমাজের স্বার্থ কেবল আত্মস্বার্থ সিদ্ধি ও প্রচেষ্টার মধ্যে নিহিত নয়; বরং সে জন্য অন্যের উপকারার্থে ব্যক্তিগত লাভ ও আয়েশ বিসর্জন দেয়াও প্রয়োজন। ... এসব দর্শন শুধু সম্পদ বণ্টনে অদক্ষতা ও অসমতার জন্ম দেয় না, তা স্বপ্ন ভঙ্গ, অপরাধ, পারিবারিক সামাজিক ধস এবং পরিশেষে মানুষের অধঃপতনও ডেকে আনে।’
প্রফেসর চাপড়া আরো বলেছেন, ইসলামী বিশ্বদর্শন তথা মাকাসিদ আল শরিয়াহ অনুসরণের মাধমে মুসলিম দেশগুলো একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কার্যকর সমাধানের পথ খুঁজে পেতে পারে। তবে সে জন্য ইসলামের শিক্ষাগুলো অনুসরণ ও সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। যেহেতু বহু মুসলিম দেশে অর্থনীতি এখনো উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেহেতু অর্থব্যবস্থা ও অর্থনীতির জন্য নতুন একটি নকশা এবং দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ সম্পর্কে আগামী সপ্তাহে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব