গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বসানো হলো ফিলিপাইনে

দক্ষিণ চীন সাগরের তীরে যুদ্ধের ছায়া

এই ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর মানেই চীনের গা ঘেঁষে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নতুন কৌশলগত ঘাঁটি তৈরি। অনেক বিশ্লেষকের চোখে যা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার মতোই এক আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ।

সৈয়দ মূসা রেজা
সংগৃহীত

একটা ঝড় আসছে। কিন্তু তার আগমন বার্তা কেউ উচ্চস্বরে দেয়নি। না কোনো কংগ্রেস বিতর্ক, না কোনো প্রকাশ্য ঘোষণা, না কোনো ভোটাভুটি। গত বসন্তে যুক্তরাষ্ট্র নীরবে বসিয়ে ফেলেছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা- ফিলিপাইনের মাটিতে, দক্ষিণ চীন সাগরের ঠিক কোলঘেঁষে। এটা একরকম গোপন সামরিক মোতায়েন, যার খবর এখন ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

ইরানের বার্তাসংস্থা তাসনিম আরো জানিয়েছে, এটা স্রেফ একবারের ব্যাপার নয়। সংবাদ সূত্র বলছে, ওয়াশিংটন আরেকটি টাইফুন ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা বসানোর পরিকল্পনা করছে ফিলিপাইনে। এই ব্যবস্থা থেকে ছোঁড়া টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার ২০০ মাইল পর্যন্ত যেতে পারে। অর্থাৎ এই ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর মানেই চীনের গা ঘেঁষে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নতুন কৌশলগত ঘাঁটি তৈরি। অনেক বিশ্লেষকের চোখে যা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার মতোই এক আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ।

চীন সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, এই ধরনের উদ্যোগ ফিলিপাইনের জন্য ‘আত্মবিনাশ’ ডেকে আনতে পারে এবং পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। তবুও যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটছে না। ম্যানিলায় এক সম্মেলনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেট বলেন, ‘ফিলিপাইনের সাথে আমাদের জোট সম্পর্ক এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।

কিন্তু সব ফিলিপিনো নাগরিক এই কথায় আশ্বস্ত নন। বিশেষ করে বামপন্থী রাজনৈতিক জোট বাগোং আলায়ানসাং মাকাবায়ান-এর সাধারণ সম্পাদক মং পালাতিনো মনে করেন, এই সামরিক জোট ফিলিপাইনের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি স্পষ্টই বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন সরকার মিলে চীনের হুমকিকে অতিরঞ্জিত করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বৈধতা দিচ্ছে। এটা ফিলিপাইনের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাকে দুর্বল করছে।’

এই পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে এক উত্তাল সমুদ্র- দক্ষিণ চীন সাগর। চীন বলছে, গোটা সমুদ্রটাই তাদের এলাকা। অন্যদিকে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশ সেই দাবির বিরোধিতা করছে। সাম্প্রতিক জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালায় চীন নাম উল্লেখ না করেই বলেছে, এই অঞ্চলে মধ্যমপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ‘শীতল যুদ্ধের মানসিকতায় ফিরে যাওয়ার মতো’ এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ।

এমন বাস্তবতায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে প্রতিদিনই জড়ো হচ্ছেন ফিলিপিনো বিক্ষোভকারীরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন মৎস্যজীবী, পরিবেশকর্মী, শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফিলিপাইন নিজেই। তারা কূটনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর আহ্বানও বারবার জানাচ্ছেন তারা।

সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই ঘটনার খবর যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই অনেক মানুষ জানেন না। সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর এমন নীতিমালাগুলো যেন চলেই যাচ্ছে কোনো আলোচনা বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়াই। সমালোচকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন ইউক্রেন যুদ্ধের কথা, যেখানে সংঘাতকে উৎসাহ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু পরিণতি অনুধাবন করা হয়নি। এখন যদি অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনকে সমর্থন দেয়া কমিয়ে দেয়, তবে এই দ্বীপ দেশকে হয়তো বড় মাশুল গুনতে হবে।

এমন এক টালমাটাল সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার নতুন আরেকটি ঘোষণা দিয়ে ফিলিপাইনকে কৌশলগত গুরুত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি ফিলিপাইন থেকে আমদানি পণ্যে শুল্কহার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৯ শতাংশ করার কথা জানিয়েছেন। অর্থনৈতিক এই বার্তা যতই আশ্বাসের হোক না কেন, ফিলিপিনো কর্মীদের কণ্ঠে এখনো ধ্বনিত হচ্ছে একই দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি চাই না, চাই শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সমাধান।

দক্ষিণ চীন সাগরের ঢেউ যে কেবল সাগরের পাড়েই থেমে থাকছে না, তা এখন প্রতিটি ফিলিপিনো বুকেই অনুভব করছেন- সেখানেই যেন শুরু হয়ে গেছে এক নতুন যুদ্ধের গল্প, যার শেষ কোথায় তা কেউ জানেনা।