সমাজে যখন নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে, তখন অন্যায়, দুর্নীতি, সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদকাসক্তি এবং জঙ্গিবাদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ বৃদ্ধি পায়। একুশ শতকের সভ্য বিশ্বেও আমরা দেখি, ছোট থেকে বড় অপরাধে যুবক-যুবতীদের জড়িত হওয়ার হার বাড়ছে। এই অবনতির জন্য কেবল ব্যক্তিকে দায়ী না করে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে—বিদ্যালয়ের শিক্ষা, সমাজের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কেমন ভূমিকা রাখছে। বিদ্যালয়, সমাজ এবং ধর্ম—এই ত্রিমাত্রিক ভিত্তি অপরাধ প্রতিরোধ ও মানবিক সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিদ্যালয়ের ভূমিকা : শিক্ষার আলোয় অন্যায় প্রতিরোধ
বিদ্যালয় হলো শিশুর নৈতিক ও সামাজিক চরিত্র গঠনের প্রধান ক্ষেত্র। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি কেবল পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দেয় কিন্তু নৈতিকতা শেখায় না, তাহলে তা সমাজে আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী নাগরিক তৈরি করে।
প্রথমত, বিদ্যালয়ে নৈতিকতা ও মানবিকতা ভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে থাকা "নৈতিক শিক্ষা" বিষয়টিকে জীবন্ত করে তুলতে হবে শিক্ষক-শিক্ষিকার জীবনঘনিষ্ঠ ব্যাখ্যা, নাটক, বিতর্ক ও গঠনমূলক ক্লাবের মাধ্যমে।
দ্বিতীয়ত, জীবনদক্ষতা ও সহমর্মিতার চর্চা শিক্ষার্থীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখায়। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক শিশুকে তার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব।
তৃতীয়ত, স্কুল কাউন্সেলিং ও মানসিক সহায়তা ব্যবস্থা চালু করে অপরাধপ্রবণ কিশোরদের সময়মতো চিহ্নিত ও পুনঃগঠনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। কারণ অপরাধবিজ্ঞান অনুসারে, অনেক অপরাধ সংঘটিত হয় শৈশবের মানসিক সংকট বা বঞ্চনা থেকে।
সমাজের ভূমিকা : পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সচেতনতায় অপরাধ রোধ
সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুরখাইম বলেন, “সমাজ যখন মূল্যবোধ হারায়, তখন অপরাধ জন্ম নেয়।” তাই সমাজকে হতে হবে মূল্যবোধের ধারক ও অপরাধবিরোধী সংস্কৃতির রক্ষাকর্তা।
প্রথমত, সমাজে বয়স্কদের মেন্টরশিপ ও প্রতিবেশী নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে কিশোর-যুবকদের বিপথগামী হওয়া ঠেকানো যায়।
দ্বিতীয়ত, যুবসমাজকে গঠনমূলক কর্মে যুক্ত করতে হবে—যেমন ডিবেট ক্লাব, কমিউনিটি সার্ভিস, সাংস্কৃতিক সংগঠন, যেখানে তারা নেতৃত্ব ও সামাজিক দায়িত্বের চর্চা শিখবে।
তৃতীয়ত, সমাজকে পুনর্বাসনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে হবে—অপরাধ করলে কেবল শাস্তি নয়, সংশোধনের সুযোগও দিতে হবে। কমিউনিটি জাস্টিস ও সালিশ প্রথা এর সফল উদাহরণ।
ধর্মের ভূমিকা : চেতনার আলোয় অপরাধ প্রতিরোধ
ধর্ম মানুষের অন্তরের জাগরণ ঘটায়। ধর্ম একমাত্র শক্তি যা মানুষকে শাস্তি নয়, আত্মশুদ্ধির পথেও চালিত করে। সকল ধর্মই অন্যায় ও মানবতাবিরোধী কাজ নিষিদ্ধ করেছে।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ ন্যায়বিচার, সদাচার এবং আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় ও অবাধ্যতা নিষেধ করেন।” (সূরা নাহল: ৯০)
রাসুল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অন্যায় দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে; না পারলে মুখে প্রতিবাদ করে; আর না পারলে অন্তরে ঘৃণা করে। আর এটি ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।” (মুসলিম)
তওবা ও সংশোধনের সুযোগ দেওয়া ইসলামী ন্যায়বিচারের মূল সৌন্দর্য।
“যে তওবা করে, সে এমন যেন সে কখনোই অপরাধ করেনি।” (ইবনে মাজাহ)
অন্যান্য ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি
হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে, “অহিংসা পরম ধর্ম।”
বৌদ্ধ ধর্মে ‘পঞ্চশীল’ অনুসারে মিথ্যা, চুরি, অসদাচরণ বর্জনীয়।
খ্রিস্টধর্মে বাইবেল বলে, “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত ভালোবাসো।” (ম্যাথিউ ২২:৩৯)
এই সকল ধর্মীয় মূল্যবোধ অপরাধের বিরুদ্ধে চেতনার খুঁটি গড়ে।
অপরাধবিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ: কী বলে আধুনিক গবেষণা
১. সামাজিক শিক্ষণ তত্ত্ব (Albert Bandura):
মানুষ অপরাধ শেখে সমাজ থেকে। তাই সমাজ ও বিদ্যালয় যদি সৎ ও গঠনমূলক আচরণের পরিবেশ তৈরি করে, অপরাধ প্রবণতা কমে।
২. স্ট্রেইন থিওরি (Robert Merton):
সমাজ যখন মানুষকে লক্ষ্য ঠিক করে দেয়, কিন্তু বৈধভাবে তা অর্জনের সুযোগ দেয় না, তখন অপরাধ বাড়ে। তাই সমাজে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ সৃষ্টি অপরিহার্য।
৩. লেবেলিং থিওরি (Howard Becker):
অল্প বয়সে অপরাধ করলে যদি সমাজ তাকে ‘অপরাধী’ হিসেবে লেবেল দিয়ে দেয়, সে ভবিষ্যতে বড় অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। বরং তার জন্য চাই সহানুভূতি ও পুনর্বাসন।
উপসংহার
অপরাধ দমন শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব নয়। সমাজে যদি বিদ্যালয় শিশুদের মধ্যে মানবিকতা ও নৈতিকতা বপন করে, সমাজ যদি সম্মান ও সহানুভূতির সংস্কৃতি গড়ে তোলে, এবং ধর্ম যদি আত্মশুদ্ধির বার্তা পৌঁছে দেয়—তবে অন্যায় ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সমাজ থেকে দূর হতেই পারে। আমাদের দরকার, এই তিনটি শক্তিকে একত্রে সক্রিয় করে একটি মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ ও অপরাধমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা।
লেখক
ডিন কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
রয়েল ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা।