এক রূপকথার বাবা

তুমি আমাদের কতটুকু সফল দেখতে চাও- তিনি হাসতেন আর বলতেন, তোমরা কেবল মানুষ হও, সফল হওয়ার দরকার নেই।

এক রূপকথার বাবা
এক রূপকথার বাবা |প্রতীকী ছবি

স্নিগ্ধা সুলতানা রামগঞ্জ, (লক্ষীপুর)

আচ্ছা, যারা কখনো চাঁদনী রাতে উঠোন পেতে রূপকথার গল্প শুনেনি- এমন এক প্রজন্মকে নিতান্তই শখের বসে যদি প্রশ্ন করা হয়, রূপকথার বাবারা কেমন হয়? তবে তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্দী, যান্ত্রিক চিন্তার, কৃত্রিম সংজ্ঞায় আমি কখনোই আমার বাবাকে সংজ্ঞায়িত করব না। এমনকি প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয়ে আসা বিশ্ব বাবা দিবসের কোনো বিশেষত্বই আমাদের মাঝে নেই, কখনো ঘটা করে বলাও হয়নি- ‘বাবা, তোমাকে ভালোবাসি’।

আমার কাছে সবসময় মনে হয়, যদি কখনো আমার বাবার ব্যক্তিত্ব, সততা, ন্যায়ের প্রতি নিষ্ঠার ছিটেফোঁটাও নিজের মধ্যে রপ্ত করতে পারি, যদি দুনিয়ার জীবনে আমি আমার বাবার জন্য সদকায়ে জারিয়া হতে পারি- তবে তাতেই হয়তো তাকে ভালোবাসা। অগাধ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মানুষটা, ব্যক্তি জীবনে খুবই সাধারণ- যার ভোর শুরু হয় সন্তানদের একটু ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা নিয়ে, আর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেন দায়িত্বের ভারে নুইয়ে পড়া কাঁধের ভারি ব্যাগ নিয়ে।

বাসায় ফিরেই তার ভীষণ ব্যস্ততা, তখনো তার পিঠে গুড়িগুড়ি ঘাম জমা, কণ্ঠনালিতে ভর করা এক রাশ ক্লান্তি। কিন্তু তিনি ছুটতেন একে একে সবার পড়ার টেবিলে- টেবিলে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ আছে কি না, ব্যাগে হাত খরচের টাকা আছে কি না, এমনকি সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মশারী টানিয়ে কয়েক দফায় মশারীর ভেতরে চেক করে দেখতেন। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুটত মশারীর এক কোণা থেকে অন্য কোণায়- যেনো অজান্তে ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়া মশার কাছেও নিজের আগলে রাখা সন্তানদের অনিরাপদ বোধ করতেন।

ঘুমের ঘোরে কেউ না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে, নিজে লোকমা ধরে খাইয়ে তবে বিছানায় যেতেন। শুধু এতটুকুই নয়- যে বিশেষ বিশেষত্ব তাকে অনন্য করে তোলে তা হলো সন্তানদের সাথে অপার সময় কাটানো। অবসরে লুডু কিংবা ক্যারম খেলায় তিনি বেশ সঙ্গ দিতেন, সবাইকে নিয়ে জমে ওঠা পারিবারিক আড্ডায় গল্প শোনাতেন। বিশেষ দিনে টুকটাক রান্না করা, মেয়েদের রান্নায় হাতে হাতে সাহায্য করা, বাদাম ভেজে খোসা ছাড়িয়ে সবার টেবিলে দিয়ে আসা, আর মায়ের সাথে গায়ে পড়ে মিষ্টি ঝগড়া করা- সবই তার সহজাত। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য তার পক্ষ থেকে থাকতো যেকোনো একটা আবদার মিটানোর বিশেষ সুযোগ। ওনার কাছে আবদার করে পাওয়া যায়নি এমন গল্পের সংখ্যা নগন্য, তার সাধ্যের সবটুকু মুড়িয়েই তিনি অগাধ ভালোবাসেন।

কারো কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা কাজে তিনি কখনোই হস্তক্ষেপ করেন না। পারিবারিক বৈঠকে তার মতামতের ভিত্তিতেই সুন্দর সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করেন। তবে একটু একটু করে গড়ে তোলা সন্তানদের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কোনো অপরাধও তাকে খুব ব্যথিত করে। আর তার শাস্তিস্বরূপ, বাবা তখন তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আত্ম-অনুশোচনায় পড়ে, হেন অপরাধ দ্বিতীয়বার না করার দৃঢ় প্রত্যয়ে বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরই তার অভিমানের মেঘ গলে যায়। স্বপ্ন দেখার হাতেখড়ি বাবার কাছে, হাড় ভাঙা পরিশ্রমের গল্পগুলো তাকে দেখেই রচিত, আর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি স্বপ্নের তীক্ষ্ণ ফলাগুলোকে লক্ষ্যে বিঁধতে সাহায্য করেন, তাই হয়তো স্বপ্নগুলো ক্লান্ত হয় না।

কোনোদিন কোনো চায়ের আড্ডায় যদি বাবাকে প্রশ্ন করি, ‘তুমি আমাদের কতটুকু সফল দেখতে চাও ‘- তিনি হাসতেন আর বলতেন, ‘তোমরা কেবল মানুষ হও, সফল হওয়ার দরকার নেই। আমার সকল চেষ্টাই তোমাদের মানুষ করার। তবে তার হাঁড় ভাঙা পরিশ্রমে প্রাপ্ত, প্রাপ্তির ঝুড়িটা ও কম কিসে, বড় মেয়ে সমবায় অধিদফতরের অডিট অফিসার হিসেবে আছেন, বড় ছেলে আজ একজন সফল ব্যবসায়ী, মেঝো মেয়ে ডাক্তারি ডিগ্রী সম্পন্ন হওয়ার পথে, ছোট ছেলে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছে। আর তার ছোট মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত আছে।

আপাতত তিনি বয়স আর দায়িত্বের সীমানা প্রান্তে, সন্তানদের জন্য  নিস্বার্থ ত্যাগের হাজার খানেক গল্প  তার হাতেই রচিত, পৃথিবীর সব বাবাদের মতো তারও একটাই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত সন্তানের, ব্যাস্তময় কর্ম জীবনের এক ফাঁকে তার ছোট মোবাইলফোনে একটা কল যাবে, কয়েক সেকেন্ডের সেই কলে জানতে চাওয়া হবে বাবা তুমি ভালো আছো? এই এতটুকুই তার কপালে পড়া ভাঁজকে শিথিল করবে, বুকভরা প্রাপ্তির এক দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যাবে দিগন্তের বাতাসে।