বৈষম্য থেকে মুক্তিই স্বাধীনতা

‘‘পশ্চিম পাকিস্তানের ধারাবাহিক স্বৈরাচারী আচরণ আর অন্যায় ও অন্যায্যতার খরগ বাঙ্গালী জাতিকে নিষ্পেষিত করেই চলেছিল। কিন্তু বাংলা ভূ-খণ্ডের মানুষের শরীরে যে পরিচ্ছন্ন রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তা কোনো নিপিড়ককেই সহ্য করে না।’’

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার
অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার |নয়া দিগন্ত

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

বাংলাদেশ আর এই মাতৃভূমিতে বেড়ে উঠা মানুষের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বিশ্বে এমন জাতি নেই যারা নিজের মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। মানুষ মাতৃভাষায় কথা বলবে এটা তার জন্মগত অধিকার। কিন্তু এই ভূখণ্ড তথা বাংলাদেশের মানুষ সেই জন্মগত অধিকার রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। কারণ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন বিলুপ্ত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান যে বৈষম্যের শিকার হয়েছিল তা সারা বিশ্বে বিরল। ব্রিটিশ শাসনে চরম বৈষম্যের শিকার এই পাক-ভারত জনপদের মানুষ ৪৭ পূর্ববর্তী যে কষ্ট সহ্য করেছিল তারই অবসান চেয়েছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান বিভাজন সেই বৈষম্য দূর করতে পারেনি।

পশ্চিম পাকিস্তানের ধারাবাহিক স্বৈরাচারী আচরণ আর অন্যায় ও অন্যায্যতার খরগ বাঙ্গালী জাতিকে নিষ্পেষিত করেই চলেছিল। কিন্তু বাংলা ভূ-খণ্ডের মানুষের শরীরে যে পরিচ্ছন্ন রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তা কোনো নিপিড়ককেই সহ্য করে না। শহীদ তিতুমির, খুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, শরিয়তুল্লাহ, দুদু মিয়াসহ বীর সেনানীর পরিচ্ছন্ন টগবগে রক্ত যাদের শরীরে প্রবাহিত তারা কি কখনই কোনো বৈষম্য স্বীকার করে নিতে পারে? তাই তো ১৯৫২ সালে পাক বাহিনী সকল বৈষম্যের সাথে ভাষা বৈষম্য জোর করে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলা ভূখণ্ডের জনগণের উপর চাপিয়ে দিবে আর সেই পদ্মা মেঘনা পাড়ের দামাল ছেলেরা অবলীলায় তা মেনে নিবে তাকি করে হতে পারে? অকুতোভয় বাঙ্গালী জাতি প্রথমে চেষ্টা করে একটা সহনশীল সম্মানের সাথে সমন্বয়ের জন্য। যখন তা সম্ভব না হয় তখনই বৈষম্যের হয়ে উঠে বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ৫২’তে সালাম, বরকত, শফিক, জব্বার, রফিক বীরত্বের সাথে নিজেই নিজেকে সপে দিয়েছে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায়। আমরা পেয়েছি একটি স্বতন্ত্র ভাষা। বাংলাভাষা পৃথিবীতে সুপরিচিতি পেয়েছে আর আমরা- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে পেয়েছি জাতিসংঘের স্বীকৃতি।

ব্রিটিশ তাড়াও আন্দোলনে যে দেশপ্রেম উৎসারিত হয়েছিল, ভাষা আন্দোলোনে তা আরও তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে বাংলাভাষাভাষি সকল মানুষের হৃদয়ে। এর পর হতে ‘৬৬’ এর ছয়দফায় বিস্ফোরিত হয়েছিল প্রকৃত বাংলার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। বাঙালির আকাঙ্খা। ৬৯’ এর গণ অভ্যুত্থানে প্রকম্পিত হয়েছিল পাকিস্তানী বেনিয়াদের গদি। এরপর ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে লাখ লাখ মা বোনের পবিত্র সম্ভ্রসের দামে কেনা এই মহান স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতাকে সময় সময় অনেকে শকুনের মত খামছে ধরেছে। ব্যহত হয়েছে আমাদের কাঙ্খিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

১৯৯০ সালে সৈরাচারের পতনের মাধ্যমে দেশে একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সাল হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ আরেক সৈরাচার জগদ্দল পাথরের মত বাংলাদেশের মানুষের, প্রাণ ওষ্ঠাগত করেছিল। অবশেষে বাংলার দামাল ছেলেমেয়ের অকুতভয় সংগ্রামে ফ্যাসিস্ট এর পতন নিশ্চিত হয়। এই পতনেও দেড় হাজার তাজাপ্রানের আত্মত্যাগ দিতে হয়েছে। আহত হয়েছে হাজার-হাজার দেশপ্রেমিক। মোটকথা সকলক্ষেত্রেই বাঙ্গালী জাতি যেমন বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তেমনিভাবে নিজেদের প্রাণ দিয়েছেন দেশের জন্য। তাই এই সকল ত্যাগ, বিসর্জন ও অর্জন সবকিছুই একই সূত্রে গাঁথা।

উদাহরণ দিলে আরও স্পষ্ট হবে। এক সময় দুইজন সেনাবাহিনীর জেনারেল একজন বিশিষ্ট সাংবাদিরকে জিজ্ঞাস করলেন প্রিয় সাংবাদিক ভাই আপনারা আমাদের মত পদস্থ কর্মকর্তাদের বীরত্বগাথা গল্প লিখে আমাদের অনেক সুবিধা প্রদান করে আসছেন। কিন্তু যারা আমাদের চেয়েও বেশি দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন ‘তাঁদের বীরত্ব কাহিনী কেন লেখেন না?

সাংবাদিক বিনয়ের সাথে ঘটনাকে পরিষ্কার করতে বললেন। তখন একজন জেনারেল এভাবেই গল্পটি বললেন যে “আমরা দুই বন্ধু তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার। মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। যে এলাকায় আমাদের দায়িত্ব পড়েছিল, সেখানে অপারেশন শেষে যখন ক্যাম্পে ফিরছিলাম তখন গেরিলা সংবাদ মারফত জানতে পারলাম পাক-আর্মি অনেক বেশি সৈন্য ও রসদ নিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। তাদের মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি একেবারে অপ্রতুল, আত্মগোপনে যাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সেই মত আমরা দুই জুনিয়র কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে একটি পুকুরে ঝাপ দেই এবং কচুরীপানা মাথায় দিয়ে আত্মগোপন করি। ঠিক এমনি মুহূর্তে একজন প্রায় ১০ মাসের অন্ত:সত্বা মা ওই পুকুর ঘাটে কাপড় ধুতে আসেন এবং আমাদের দুজনকেই পুকুরে ঝাপ দিতে এবং কচুরীপানা মাথায় দিয়ে আত্মগোপনের দৃশ্য দেখে ফেলেন এবং মিট মিট করে হাসতে হাসতে তাঁর কাপড় ধোয়ার কাজ করতে থাকেন এবং মাঝে মাঝে আমাদের দেখছিলেন। ঠিক কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনা এসে মহিলাকে ঘিরে ধরে এবং মহিলাকে জিজ্ঞাস করে মুক্তি কোন হ্যায়? উনি পরিস্কার উত্তর দেন আমি জানি না। কয়েকবার- জিজ্ঞাস করার পর পাক আর্মি তাদের স্বভাব সুলভ নির্মমতায় মাটির উপর ফেলে পেটে লাথি মারে এবং যখন উনি মাটিতে আছড়ে পরেন, তখন পাক সেনারা চাকু দিয়ে মায়ের পেট চিরে শিশুটিকে বের করে নেয় এবং নির্মম নিষ্ঠুরভাবে মা ও অনাগত নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে মেরে ফেলে।”

গল্প বলা শেষ করে জেনারেল সাহেব সাংবাদিককে প্রশ্ন করলেন এখন বলুন তো সামারিক প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় আমরা যুদ্ধ করেছি। আর এই মা কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই কোনো অস্ত্র ছাড়াই তিনি নিজে ও তাঁর অনাগত নিষ্পাপ সন্তানটিকে শহীদ করে দিলেন তাহলে কে বড় মুক্তিযোদ্ধা বলেন? এই মায়ের একমাত্র অস্ত্র-ছিল দেশপ্রেম। প্রশিক্ষণ ছিল দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা। এই মায়েরই সন্তান ২৪ এর যোদ্ধা সাঈদ, মুগ্ধরা। তাই তো এতো তেজ তাদের রক্তে। এই অকুতভয় মায়ের সন্তানরাই সশস্ত্র ফ্যাসিবাদের পুলিশকে কোনো তোয়াক্কাই করেনি। তাই তো একজন পুলিশ অফিসার ফ্যাসিবাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলছিল, “স্যার- একটা গুলি করি, একটাই মরে একটাই যায় আর কেউ নড়ে না”।

কিভাবে নড়বে এদের রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে ওই বীরোচিত মায়ের রক্ত। যাঁর আকাঙ্খা ছিল দেশের সার্বিক মঙ্গলে।

কবি কাজী নজরুলের ভাষায়

‘এই মোর সাধ, সাধনা-আমার, প্রার্থনা নিশিদিন

মানুষ রবে না অন্ন বস্ত্রহীন আর পরাধীন’

তাই সত্যিই ৫২, ৭১, ৯০, ২৪ একই মোহনায় মিলিত।

লেখক

অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

কীটতত্ত্ব-বিভাগ

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম সহাখালী ঢাকা