ফ্যাসিবাদ পরবর্তী নতুন ডাকসু ও জনপ্রত্যাশা

এবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পুরো দেশবদলের চেতনার আলোতে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরিপূর্ণভাবেই উদগীরিত স্ফূলিঙ্গের মতো টেনেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে সবাইকে। দেশবাসী বুক ভরা আশা নিয়ে স্বপ্ন বুনেছে ডাকসু হবে জুলাই চেতনার অনবদ্য কণ্ঠস্বর, শহীদদের আকাঙ্ক্ষার রক্ষাকবচ, ফ্যাসিবাদবিরোধী জাগরুক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) |ফাইল ছবি

বহু আন্দোলন সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসু নির্বাচন সম্প্রতি হয়ে গেল। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী ঢাবির সচেতন ছাত্রসমাজ ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-কে ডাকসুতে নির্বাচিত করেছে। ভিপি, জিএস, এজিএস’সহ প্রায় সকল পদে এ জোট ডাকসুর ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছে, যা ডাকসুর আগামীর চরম প্রতীক্ষিত অবশ্যম্ভাবী কার্যকারিতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ফ্যাসিবাদ পরবর্তী জাতিগঠনে এমন একটি শক্তিশালী ও সংগঠিত ডাকসুর অতীব প্রয়োজন ছিল।

ডাকসুকে বলা হয় দেশের দ্বিতীয় সংসদ। কেননা, এখান থেকেই যুগে যুগে দেশপ্রেমিক মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের নেতৃত্বে গিয়েছে এবং সাধারণ মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, এটি দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। ডাকসু দেশে গণতন্ত্র এবং ইতিবাচক ধারায় সব সময় ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রদের অধিকার আদায়ে ডাকসু যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি দেশের মানুষের অধিকারের জন্যও তারা সক্রিয় থেকেছে। দেশের মানুষ কোনো অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ দেখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডাকসুর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ঢাবি সব সময় পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, ডাকসু ও হল সংসদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৩৭ বার নির্বাচন হলেও স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র আটবার। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৯ সালে, সেটিও শেষ হয়েছিল চরম বিতর্কের মধ্য দিয়ে। ফলে জাতির সিপাহসালার তথা দিকপাল গঠনের উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী ডাকসু গঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা গোটা জাতির কাছে তীব্র কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছিল। সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দীর্ঘ ছয় বছর পর আমরা নতুন ডাকসু পেলাম।

এমন এক সময় নতুন ডাকসু গঠিত হলো, যখন মাত্রই শিক্ষার্থীরা এক সাগর রক্ত পেরিয়ে বিস্তীর্ণ বালু প্রান্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ ষোলো বছরে স্বৈরাচারী খুনী হাসিনার সন্ত্রাসী হেলমেট বাহিনীর ‘নাৎসি’ আক্রমণ আর তাবেদার পুলিশ বাহিনীর গণহত্যা, গুম, খুন, টিয়ারশেল, বুলেট, গ্রেনেড ও আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার মতো পৈশাচিক বীভৎসতায় সহস্রাধিক শহীদের সাথে অগণিত ছাত্রজনতা আজীবনের জন্য করেছে পঙ্গুত্ব বরণ।

এবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পুরো দেশবদলের চেতনার আলোতে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরিপূর্ণভাবেই উদগীরিত স্ফূলিঙ্গের মতো টেনেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে সবাইকে। দেশবাসী বুক ভরা আশা নিয়ে স্বপ্ন বুনেছে ডাকসু হবে জুলাই চেতনার অনবদ্য কণ্ঠস্বর, শহীদদের আকাঙ্ক্ষার রক্ষাকবচ, ফ্যাসিবাদবিরোধী জাগরুক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। নতুন ডাকসুর কাছে তাই প্রত্যাশা নিম্নরূপ :

১। সন্ত্রাস ও মাদক মুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস :

প্রশাসনের সহযোগিতায় ডাকসুকে ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি সিন্ডিকেটকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেকহোল্ডার শুধুমাত্র ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এখানে সন্ত্রাস ও মাদক কারবারের কোনো স্থান নেই।

২। অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও অপসংস্কৃতি বিলোপ :

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে বিরাজমান অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হানাহানি এবং দখলদারিত্বের অপসংস্কৃতি চিরতরে দূর করা জরুরি। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করে সংলাপ ও সহযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। হয়রানি ও সহিংসতাহীন মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

৩। শিক্ষা সমস্যায় গঠনমূলক ভূমিকা :

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ছাত্র সংসদগুলো শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা এবং লেখাপড়া সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। ডাকসুকে এমন সুস্থ ও কল্যাণমুখী ছাত্ররাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ধারায় শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য হবে পড়াশোনা, শিক্ষা-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান এবং অধিকার রক্ষায় গঠনমূলক ভূমিকা পালন।

৪। শিক্ষা ও গবেষণায় উৎকর্ষতা :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে খ্যাত ছিল। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে এটি অনেক পিছিয়ে। এর মূল কারণ হলো শিক্ষার মানের ঘাটতি ও গবেষণায় অনাগ্রহ। তাই ছাত্র প্রতিনিধিদের দায়িত্ব হবে শিক্ষা উন্নয়ন ও গবেষণা প্রসারে উদ্যোগ নেয়া। গবেষণার বাজেট বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করা জরুরি। এতে একদিকে একাডেমিক মান বাড়বে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাও বিশ্বে উন্নত হবে।

৫। আন্তর্জাতিক মান এবং আধুনিক অবকাঠামো :

এক সময় পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে এমনকি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকেও বহু শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত। আজ সেই দিন নেই বললেই চলে। এর মূল কারণ উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মানের সাথে তাল মেলাতে না পারা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষা কার্যক্রম, গবেষণাকর্ম এবং প্রশাসন যেভাবে পরিচালিত হয় সেভাবে নতুন বিধি-বিধান প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে।

৬। শিক্ষার্থীবান্ধব আবাসন :

সত্যিকারের শিক্ষার্থীবান্ধব আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক হল বিনির্মাণে উদ্যোগী হতে হবে। হলগুলোতে সিট বণ্টনে স্বচ্ছতা থাকতে হবে, প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন ন্যায্যভাবে হলে থাকার সুযোগ পায়, সেটাই হবে প্রত্যাশা। জায়গা সংকুলান না হওয়া ছাত্রদের সাময়িক আবাসন ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। অতীতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন, আবাসিক হলে গণরুম-গেস্টরুম নামে অপসংস্কৃতির স্থায়ী সমাধান করতে হবে।

৭। মৌলিক সুযোগ-সুবিধাসহ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা :

ডাকসু প্রতিনিধিদের উচিত শিক্ষার্থীদের মৌলিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। হলগুলোর রিডিং রুমে পর্যাপ্ত আসন, পরিবেশ, এসি/ফ্যান, পরিচ্ছন্ন ক্যান্টিন, ওয়াশরুম সহ বিভিন্ন একাডেমিক ভবন, ক্লাসরুম, সেমিনার, লাইব্রেরি ইত্যাদিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দূরীভূত করা জরুরি। ইতিমধ্যেই জিএস এস এম ফরহাদ ঘোষণা দিয়েছেন প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে ক্যাম্পাসে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনার, যেটা সত্যিকার অর্থেই আশায় প্রেরণা যুগিয়েছে।

৮। শিক্ষা ও শিল্পের মধ্যে সেতুবন্ধন :

ডাকসুকে শিক্ষার্থীদের গবেষণা, লেখা ও সম্পাদনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ও শিল্পের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। একাডেমিক এক্সিলেন্স তৈরি করতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও সহায়ক শিক্ষা কার্যক্রম উন্নয়নে নানা রকম উৎসাহ উদ্দীপনামূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।

৯। ধর্ম ও ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার দিকনির্দেশনা হতে হবে স্বদেশকেন্দ্রিক। জাতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে এমন এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে সমুন্নত রাখবে। এক্ষেত্রে যুগোপযোগী এবং বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতি গঠনের সাথে সামঞ্জস্যশীল নতুন নতুন বিষয়ে অনার্স চালুর জন্য ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হবে জ্ঞানের সব শাখার অবারিত ভাণ্ডারের উন্মুক্ত দ্বার। ডাকসুকে এ ব্যাপারে সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক ভূমিকা নিতে হবে।

১০। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ :

আমরা আশা করি, ঢাবিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, মত নির্বিশেষে বিভিন্ন সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও দলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে নতুন ডাকসু অনন্য নযীর স্থাপন করবে।

১১। নারী সহায়তা সেল :

নারী শিক্ষার্থী ও শিক্ষিকাদের হয়রানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিযোগের ব্যাপারে কার্যকর সহায়ক ব্যবস্থা ও সেল গঠন করতে হবে। আমরা চাই নতুন ডাকসুর আওতায় নারীরা নিজেদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ মনে করবে। তাদের মতামত ও পরামর্শ শোনার জন্য হল ভিত্তিক ‘লিচেনিং টু হার ভয়েস’ জাতীয় ইন্টারেক্টিভ ডিসকাশনের আয়োজন করা যেতে পারে।

১২। সাহসী তারুণ্য ও যোগ্য নেতৃত্ব :

ডাকসু তৈরি করবে নতুন সাহসী ও যোগ্য নেতৃত্ব, যারা শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন, গবেষণার প্রসার এবং আধুনিক অবকাঠামো নিশ্চিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার হারানো গৌরবে ফিরিয়ে আনবে।

১৩। ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ ও উপনিবেশবাদের মূলোৎপাটন :

চব্বিশের ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দল ও রাজনীতির ব্যাপারে সচেতন ও সোচ্চার থাকতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ এবং উপনিবেশিক শক্তি ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে মুক্ত করতে হবে। সম্মিলিতভাবে ক্যাম্পাস থেকে ফ্যাসিবাদী আইকন, অবকাঠামো, রাজনীতি এবং চরিত্রের মূলোৎপাটন করতে হবে। জুলাইয়ের ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দোসররা নানা কৌশল ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেশকে বিপথে নেয়ার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় ছাত্র সমাজকে সচেতন থাকতে হবে। খুনি হাসিনা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পক্ষাবলম্বনকারী শিক্ষকদের বয়কট করে ক্যাম্পাস থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে। সকল ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তথ্য, যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

১৪। জুলাই এর আকাঙ্ক্ষা ধারণ ও প্রকাশ:

ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের আশা আকাঙ্ক্ষাসহ জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস ও চেতনাকে ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে। ডাকসু হবে জুলাই আন্দোলনের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্ম। পুরাতন বন্দোবস্ত ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় ভূমিকা নিতে হবে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট, হল ও কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত সাময়িকী, ম্যাগাজিন, জার্নাল, নাটক, মূকাভিনয়, চিত্র প্রদর্শন ইত্যাদিতে জুলাই শহীদদের স্মৃতি, তথ্য ও ঘটনাবলি প্রকাশ করতে হবে।

১৫। ৭৩-এর অধ্যাদেশ ও কোটা প্রথা বাতিল :

৭৩ সালের অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বচ্ছতা, দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও অযোগ্যদের নিয়োগকে উৎসাহিত করে, যার ফলে শিক্ষা ও প্রশাসনের মান হ্রাস পায়। এই অধ্যাদেশ বাতিলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করা জরুরি। শিক্ষকদের স্থায়ী নিয়োগ ব্যবস্থাও বাতিল করতে হবে। যথেচ্ছাচার, অবিচার এবং ফাঁকিবাজি রোধে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং ছাত্রদের প্রদত্ত রেটিং অনুযায়ী শিক্ষকতার মান বিচার করে নিয়োগ নবায়ন করতে হবে। অযোগ্যভাবে নিয়োগ পাওয়া দলীয় শিক্ষক ও কর্মচারীদের তালিকা প্রকাশ ও অপসারণের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরতে হবে। শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার দৌহিত্র এবং পোষ্য কোটা বাতিল করতে হবে।

১৬। কার্যকর ও ফলদায়ক অ্যালামনাই :

ঢাবির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ও হল এলামনাইকে কার্যকর ও ফলদায়ক করতে বর্তমান ডাকসুকে ব্যাপক ভূমিকা নিতে হবে। প্রতিষ্ঠিত প্রাক্তনদের সাথে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। তাদের একক অথবা সম্মিলিত নামে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ও হলে বৃত্তির ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই হবে বর্তমান শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। তাদের সাহায্য সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনায় আজকের ঢাবি হবে ভবিষ্যতের একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত বিদ্যাপীঠ।

১৭। বিধ্বংসী ও সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিবাদ :

ডাকসুকে শুধুমাত্র ক্যাম্পাস নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও সোচ্চার ও পাঞ্জেরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিধ্বংসী ও সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। পরাজিত শক্তি ভয় ও হতাশায় নিউইয়র্ক ও লন্ডনে যে সহিংস আক্রমণ করেছে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী ও জাগরুক কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে হবে।

১৮। রাষ্ট্রীয় মদদে গুম, খুন ও গণহত্যার বিচার দাবি :

রাষ্ট্রীয় মদদে সকল গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, শতাব্দীর নৃশংস ও বর্বরতম পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় পরবর্তী গণহত্যা, জুলাই গণহত্যাসহ দমন পীড়নমূলক সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবিতে ডাকসুকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে, সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে।

ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতৃত্বাধীন নতুন ডাকসু হোক আগামী দিনের পথ চলার নতুন কেন্দ্রবিন্দু। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত শিক্ষার্থীরা সাহসী ও সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে সব কূটকৌশল ও বাধা উপেক্ষা করে এই প্যানেলকে জয়ী করেছে। আমরা জানি, মোবাইল তথা পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘোরা এই ‘জেন-জি’ (জেনারেশন অব জিরো ডিফিট)-কে কোনোভাবেই দমিয়ে রাখা যাবে না। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় হলো স্বাধীন চিন্তা ও মুক্ত মতপ্রকাশের ক্ষেত্র—যেখানে ছাত্রদের কণ্ঠস্বরকে বাঁধা নয়, বরং শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। ‘বিক্রি হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক’, ‘ট্রেন্ডে গা ভাসানো’, ‘পশ্চাদপদ’ ইত্যাদি ইনসাল্টিং শব্দে খিস্তি আউড়ে কোনোভাবেই কাবু করা যাবে না এই তারুণ্যকে। এক ‘রাজাকার’ শব্দ আউড়েই খুনি ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে লেজ গুটিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। সুতরাং বাস্তবতাকে মানতে হবে। মানুষের মনের ভাষা ও আবেগকে বুঝতে হবে। এটা বুঝতে যতো দেরি করব, ততোই যেন আমরা ছিটকে পিছনে পড়ে যেতে থাকব।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়