ঢাবির হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ : বিতর্ক, প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

ঘটনার সূত্রপাত ৯ আগস্ট রাত থেকে। এর আগে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের জন্য আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে। ঘোষণার পরপরই হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে অংশ নেন।

Location :

Dhaka City
নিজ বাসভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ (৮ আগস্টের ছবি)
নিজ বাসভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ (৮ আগস্টের ছবি) |নয়া দিগন্ত

মোহাম্মদ ইব্রাহিম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু। ডাকসু নির্বাচন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন-সবক্ষেত্রেই ঢাবির ছাত্ররাজনীতি মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবাসিক হলে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষাঙ্গনে বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে। এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে প্রশাসন, ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেউ এটিকে ক্যাম্পাসের শান্তি ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতের পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ মনে করছেন এটি বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টা। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে এই পদক্ষেপ আরো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।

ঘটনার সূচনা

ঘটনার সূত্রপাত ৯ আগস্ট রাত থেকে। এর আগে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের জন্য আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে। ঘোষণার পরপরই হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে অংশ নেন।

শুক্রবার গভীর রাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে তারা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। রাত দুইটার দিকে ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ সেখানে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করেন।

ভিসি জানান, ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই হল প্রভোস্টদের বৈঠকে গৃহীত ‘হল পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত’ রাখার সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এসময় ‘নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি নয়, সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’ দাবি করেন।

অবশেষে রাত তিনটার দিকে শিক্ষার্থীদের চাপে প্রক্টর ঘোষণা দেন-হলগুলোতে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে।

প্রশাসনিক প্রজ্ঞাপন ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

প্রক্টরের ঘোষণার আধঘণ্টা পর স্যার এ এফ রহমান হল থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এতে বলা হয়-যে সকল শিক্ষার্থী রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কমিটিতে আছেন, তারা পদত্যাগপত্র ও মুচলেকা জমা দিলে হলে থাকতে পারবেন, অন্যথায় তাদের বহিষ্কার করা হবে।

এই ঘোষণার পেছনে রয়েছে এক বছরের পুরনো একটি প্রেক্ষাপট। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগ আবাসিক হলে হামলা চালায়। দুই দিন পর শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছাত্রলীগকে হল থেকে বের করে দেয়। তখনই শিক্ষার্থীরা প্রতিটি হলে প্রভোস্টের স্বাক্ষরে রাজনীতি নিষিদ্ধের বিজ্ঞপ্তি আদায় করে। সেই নীতিই কার্যত ২০২৫ সালের আগস্টে নতুন করে কার্যকর হলো।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রশাসনের পদক্ষেপ

এক শিক্ষকের সরকার বিরোধী পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সাময়িকভাবে অ্যাকাডেমিক কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনাও এ প্রেক্ষাপটে আলোচনায় রয়েছে। তবে প্রশাসনের দাবি, এটি ছাত্রদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে নেয়া হয়েছিল, যার ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কোনো ধরনের চাকরিচ্যুতি বা বেতন কর্তন হয়নি।

অন্য দিকে মাস্টার দা সূর্য সেন হল ও রোকেয়া হলে শিবিরের দেয়া ফিল্টার ভাঙার ঘটনাও এ সময় আলোচনার জন্ম দেয়। কেননা এই ঘটনা ঘটে এমন সময়, যখন আবাসিক হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এই ধরনের হামলা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।

তবে ভিসি জানিয়েছেন, নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পাসে প্রায় ১৮৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এছাড়া প্রক্টরিয়াল টিমকে সহযোগিতার জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করতে ক্যাম্পাসের ছয়টি স্থানে বিশেষ ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।

গত কয়েকদিনের ছাত্র আন্দোলন ও বিক্ষোভের সময় প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। উপাচার্য বলেন, ‘ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থে ঐক্য বজায় রাখুক, যাতে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে না পারে।’

বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ছাত্রদল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন প্রক্টরের সিদ্ধান্তকে ‘বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা’ হিসেবে আখ্যা দেন। তার ভাষায়, ‘প্রক্টরের কি এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আছে? এটি হয়তো উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে বলা হয়েছে।’ তিনি আরো আশঙ্কা প্রকাশ করেন—প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে গুপ্ত রাজনীতি বেড়ে যাবে, যা আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

ইসলামী ছাত্রশিবির : ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এসএম ফরহাদ বলেন, ‘আমরা হলভিত্তিক রাজনীতি নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী।’

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ : গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক আবদুল কাদের মনে করেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই হলে রাজনীতি না চাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘হল ও একাডেমিক এলাকায় রাজনৈতিক কার্যক্রম না চালানোর বিষয়ে অনেক সংগঠনের মধ্যেই অলিখিত সমঝোতা ছিল।’

বামপন্থী ছাত্রসংগঠন : বামপন্থী সংগঠনগুলোর নেতারা এই নিষেধাজ্ঞার আইনি বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরিসরে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আইন নেই। প্রক্টরের একক ঘোষণার মাধ্যমে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় না।

ডাকসু নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ইতোমধ্যে নির্বাচন ঘিরে তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে-প্রার্থী মনোনয়ন, প্রচারণা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা প্রভাবিত হবে?

বিশ্লেষকদের মতে, হলে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলে ডাকসু নির্বাচনে বড় দলগুলোর সাংগঠনিক সুবিধা কমে যাবে। একইসঙ্গে স্বাধীন প্রার্থীদের জন্য সুযোগ বাড়তে পারে। তবে গোপন সমর্থন ও অনানুষ্ঠানিক প্রচারণা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও ক্ষোভের কারণ

গত এক দশকে আবাসিক হলে দলীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, সিট বাণিজ্য, নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অসংখ্য অভিযোগ জমেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ-দলীয় প্রভাবশালী ছাত্রনেতারা সিট বরাদ্দ, খাবার মান, হলের নিরাপত্তা-সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, যা শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নষ্ট করে।

২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়কার সহিংসতা শিক্ষার্থীদের মনে গভীর ক্ষোভ তৈরি করে। ফলে অনেকে মনে করছেন-রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে অন্তত হলগুলোতে সহিংসতা কমতে পারে।

আইনি ও নীতিগত বিতর্ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী, ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃত সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ। ফলে প্রশ্ন উঠছে-প্রক্টর বা প্রভোস্টের সিদ্ধান্তে কি এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ সম্ভব? আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিগত পরিবর্তন করতে হলে সিনেট বা সিন্ডিকেটের অনুমোদন প্রয়োজন।

সম্ভাব্য প্রভাব ও ভবিষ্যৎ চিত্র

গোপন রাজনীতির উত্থান : প্রকাশ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে গোপনে সংগঠন পরিচালনা বাড়তে পারে, যা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে সহিংসতা বাড়াতে পারে।

ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক দুর্বলতা : হলে অবস্থান ও সংগঠন চালানোর সুযোগ কমে গেলে বড় রাজনৈতিক দলগুলো কাঠামোগতভাবে দুর্বল হতে পারে।

নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক সংস্কৃতি : ডাকসু নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে হয়, তাহলে স্বাধীন প্রার্থীদের উত্থান ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচারণার সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে।

শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের সম্ভাবনা : প্রশাসনের প্রত্যাশা—হলগুলোতে রাজনীতি বন্ধ হলে সহিংসতা কমবে, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ উন্নত হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি একদিকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব তৈরির বিদ্যালয়, অন্যদিকে দলীয় সহিংসতার ক্ষেত্র। নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে প্রশাসনের উচিত ছিল ছাত্র-শিক্ষক ও সংগঠনগুলোর মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে নীতিমালা প্রণয়ন করা।

নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সমস্যার মূল কারণ দূর করা যাবে না। বরং সুস্থ ও নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি চর্চার সুযোগ দিতে হবে।

শেষ কথা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি দেশের উচ্চশিক্ষার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বড় মোড়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও উত্তেজনা প্রশমনে প্রশাসন, ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ অপরিহার্য।

আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচন এই সংকটের নতুন অধ্যায় উন্মোচন করতে পারে-যেখানে ক্যাম্পাসে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে অথবা গোপন রাজনীতির প্রসার ঘটতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা, শিক্ষাবান্ধব শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত এবং শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য সকল পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

লেখক : নয়া দিগন্তের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী।