জুলাই বিপ্লব

১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান

ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

শাহাব উদ্দিন শিহাব
শাহাব উদ্দিন শিহাব

শাহাব উদ্দিন শিহাব

২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় ঘটনা। জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল একটি গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থান, যা ২০২৪ সালের ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট গিয়ে শেষ হয়। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সকল বয়সী অগণিত মানুষের জীবনের বিনিময়ে অবসান হয় বিগত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের।

স্বাধীনতা-পূর্ব ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছাত্রদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯০ সালের আন্দোলনে ছাত্ররা এরশাদ সরকারের পতনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও ছাত্রদের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। স্বৈরশাসক হাসিনার কঠোর একগুয়েমী অবস্থানের কারণে আরো প্রবল হয়ে উঠেছিল সেই আন্দোলন। যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। অগণিত মানুষকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে দেশকে শাসন করার পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তার পালিয়ে যাওয়ার খবরে দেশ এবং বিদেশের বাঙালিরা আনন্দ ও উচ্ছ্বাস-উল্লাসে ফেটে পড়ে। দলে দলে কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে পড়েন।

হাসিনা দল-বল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ‘তিন’ দিন পর দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।

হাসিনার পতন এত সহজ ছিল না। ১৮ জুলাই ‘সম্পূর্ণ শাটডাউন’ কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ জেলাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী পরিবহন বন্ধ করে দেয়। পুলিশ ও ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালালে কমপক্ষে ২৯ জন শহীদ হন। এছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দমনে অবৈধ হাসিনা সরকার দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। ঢাকা ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, পুলিশের গুলি ও হামলা হয়। এসব ঘটনায় আহত হয় অন্তত দেড় হাজার মানুষ। এদিনই সারাদেশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়।

১৯ জুলাই মধ্যরাতে শেখ হাসিনা সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে এবং দিনব্যাপী আন্দোলনকারীদের ওপর হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এতে কমপক্ষে ৬৬ জন নিহত হন। এরপর দেশব্যাপী মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। নরসিংদীর কারাগার, মেট্রোরেল স্টেশন ও বিআরটিএ অফিসসহ আরো সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বাধা দেয়ার প্রয়াসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জনসমাগম ও মিছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। তবে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন সহিংসতা, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও মৃত্যুতে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ।

ওইদিন শুধু রাজধানীতেই গুলি করে ৪৪ জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে কমপক্ষে ৫৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে হাসিনার পেটুয়া বাহিনী। এতে ছাত্র, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, পথচারীসহ কয়েক শতাধিক মানুষ আহত হয়। শুরু থেকে শুধু শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নিলেও ওইদিন থেকে স্থানীয় ও সাধারণ মানুষ আন্দোলনে যোগ দেন।

হত্যা, গণগ্রেফতার, হামলা, মামলা, জোরপূর্বক গুম এবং ছাত্র ও নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে ছাত্ররা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে প্রতিবাদ শুরু করে।

সবশেষ ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ কারফিউ অমান্য করে রাজধানীতে একত্রিত হয়। হাসিনার পতনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে আগ্রাসন প্রদর্শন করে। ‘মার্চ টু ঢাকা’ ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও দেশবাসী রাজধানী অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। দুপুর নাগাদ লাখো জনতার সমাঘম ঘটে হাসিনার সরকারি বাসভবনে। বিকেলে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে তার পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করেন স্বৈরশাসক হাসিনা।

এরপর হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বিমানে করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। এর পর থেকে ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বিতাড়িত হয়। শেখ হাসিনার সাথে ৩৫০ এমপি-মন্ত্রীসহ দেশের সকল জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সকল অঙ্গসংগঠনের নেতাদের অনেকেই দেশের বাইরে পালিয়ে যান, আবার অনেকে দেশেই আত্মগোপন করেন।

দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেশিভাগ মানুষের সমর্থনে এ সরকার গঠিত হয়। তাই দল-মত নির্বিশেষে সবার উচিত এ সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করা। আর জুলাই ২৪-এ আন্দোলন করতে গিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন, আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর মতো ‘জুলাই ২৪’কেও যেন স্মরণ করতে পারি সেই প্রত্যাশা সবার প্রতি।

লেখক, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক।