বাংলাদেশ : ‘ব্লু-গোল্ড’ অর্থনীতিতে এক উদীয়মান শক্তি

বাংলাদেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২,৩০০ মিলিমিটার, এবং দেশের বুক চিরে প্রবাহিত হচ্ছে ৭০০টিরও বেশি নদ-নদী। প্রতিবছর এসব নদীর মাধ্যমে প্রায় ১২০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, যার বিশাল অংশ কোনো প্রকার ব্যবহার ছাড়াই সাগরে মিশে যায়।

কবীর আহমেদ ভূঁইয়া
কবীর আহমেদ ভূঁইয়া

আলহাজ কবীর আহমেদ ভূঁইয়া

বিশ্বে যখন নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানযোগ্য পানির সংকট দ্রুত তীব্রতর হচ্ছে, তখন প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ নদী, খাল, হাওর-বাঁওড়, জলাভূমি এবং বর্ষাজনিত পানির ভাণ্ডার নিয়ে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় পানি কেবল জীবনের উৎস নয়—এটি হয়ে উঠছে অর্থনীতি, কূটনীতি ও নিরাপত্তার অন্যতম কৌশলগত উপাদান। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের বিশাল মিঠাপানির ভাণ্ডারকে ২১শ’ শতকের “ব্লু-গোল্ড” বা ‘নীল-সোনা’ হিসেবে ব্যবহার করা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হতে পারে—যা দেশের রপ্তানি, কর্মসংস্থান এবং কৌশলগত অবস্থানকে আমূল বদলে দিতে সক্ষম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২২০ কোটিরও বেশি মানুষ নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে। জাতিসংঘের পূর্বাভাস বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ জনগণ মারাত্মক পানি সংকটে পড়বে। এই বাস্তবতায় বিশুদ্ধ পানির বাজার দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে—২০২৪ সালে বোতলজাত পানির বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল প্রায় ৩২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৪৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

এদিকে, বাংলাদেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২,৩০০ মিলিমিটার, এবং দেশের বুক চিরে প্রবাহিত হচ্ছে ৭০০টিরও বেশি নদ-নদী। প্রতিবছর এসব নদীর মাধ্যমে প্রায় ১২০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, যার বিশাল অংশ কোনো প্রকার ব্যবহার ছাড়াই সাগরে মিশে যায়। অথচ এই বিপুল সম্পদকে যদি প্রযুক্তিগতভাবে প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পানিতে রূপান্তর করা যায়, তবে তা হতে পারে একটি টেকসই রফতানি শিল্পের ভিত্তি।

সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পানি স্বাভাবিকভাবেই pH ও TDS মানে ভারসাম্যপূর্ণ—যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পানযোগ্য পানির মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই গুণগত বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন ফ্রান্সের Evian বা আইসল্যান্ডের Icelandic Glacial পানির মানের সাথে তুলনীয়, যা বাংলাদেশের পানিকে একটি সম্ভাব্য ‘বিশ্বমানের ব্র্যান্ড’ হিসেবে উপস্থাপন করার পথ সুগম করে।

বাংলাদেশে বৃষ্টির ৮০ শতাংশই হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। এই মৌসুমি পানি যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করা যায়, তাহলে দেশের অভ্যন্তরেই তৈরি হতে পারে এক শক্তিশালী “ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রি”। কম খরচে উৎপাদন, স্বল্প মজুরির দক্ষ জনশক্তি (যেখানে গড় মাসিক শ্রমিক মজুরি মাত্র ১০৫ মার্কিন ডলার), এবং দ্রুত উন্নয়নশীল বন্দর অবকাঠামো যেমন চট্টগ্রাম, মংলা ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে একটি আদর্শ পানির রপ্তানিকেন্দ্র।

এর সাথে রয়েছে বাংলাদেশের অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান। একদিকে বিশাল ভারতের সীমান্ত, অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রবেশদ্বার হয়ে চীনের বিশাল বাজারের সংযোগ—এই মিলিত অঞ্চলটিই তৈরি করেছে প্রায় অর্ধ বিশ্বের সমান এক বিশাল ভোক্তা বাজার। এই বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ একটি অত্যন্ত কৌশলগত সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে ৪ থেকে ৪.৫ ঘণ্টার বিমান যোগাযোগ বাংলাদেশকে করে তুলেছে একটি আদর্শ গ্লোবাল লজিস্টিক গেটওয়ে।

বাংলাদেশ যদি এই সম্ভাবনাকে একটি পরিকল্পিত শিল্পে রূপ দিতে চায়, তবে একটি সুসংগঠিত জাতীয় রূপরেখা গ্রহণ করা জরুরি। এর আওতায় থাকা উচিত:

  • বর্ষাকালীন পানি সংরক্ষণের জন্য পরিবেশবান্ধব রিজার্ভার, বাঁধ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা।
  • আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন RO ও UV প্রযুক্তিনির্ভর বিশুদ্ধিকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন।
  • হাওর অঞ্চলকে "ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন" হিসেবে রূপান্তর।
  • বোতলজাত পানির জন্য “রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল” (BWEPZ) গঠন, যেখানে থাকবে করমুক্ত সুবিধা ও হালাল সার্টিফিকেশন।
  • একটি “জাতীয় পানি মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ” প্রতিষ্ঠা, যা নিশ্চিত করবে প্রতিটি এক্সপোর্ট ইউনিটে ডিজিটাল ট্র্যাকিং, ISO ও হালাল মানসম্পন্নতা।

একটি বৈশ্বিক রাষ্ট্রীয় ব্র্যান্ড: “Bangladesh Pure Water”, যা পরিবেশবান্ধব, বিশুদ্ধ এবং ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য (হালাল সার্টিফায়েড) হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতি পাবে।

বিশ্বে ইতোমধ্যেই অনেক দেশ জলসম্পদকে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ:

  • সিঙ্গাপুর তাদের NEWater প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্জ্যপানি পুনর্ব্যবহার করে পানযোগ্য করেছে।
  • সৌদি আরব বিশাল পরিশোধন প্ল্যান্ট ও হালাল ব্র্যান্ডিং-এর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে বিশুদ্ধ পানির বাজার দখল করেছে।
  • চীন খনিজসমৃদ্ধ "ফাংশনাল ওয়াটার" রফতানিতে বৈশ্বিক অবস্থান তৈরি করেছে।
  • ফ্রান্স তাদের প্রাকৃতিক ঝরনার পানি (Evian) বিশ্বব্যাপী বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
  • ভারত Bisleri ও Himalayan-এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে।

বাংলাদেশ এই উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব কম খরচে, প্রাকৃতিকভাবে টেকসই এবং কৌশলগতভাবে প্রভাবশালী এক পানিনির্ভর রপ্তানি অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে।

বিশ্ববাজারে বোতলজাত পানির যদি মাত্র ৫% অংশও বাংলাদেশ দখল করতে পারে, তবে দেশটি বছরে আনুমানিক ১৫.২৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় অর্জন করতে পারে। সেই সাথে তৈরি হতে পারে ৫ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান, বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং গড়ে উঠবে একাধিক সংশ্লিষ্ট শিল্পখাত—যেমন প্যাকেজিং, কাঁচের বোতল, প্লাস্টিক বোতল, গবেষণা, প্রযুক্তি, পরিবহন ও ব্র্যান্ডিং।

বাংলাদেশের জলসম্পদ এখন আর কেবল একটি প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য নয়—এটি হতে পারে জাতির টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন ভিত্তি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বের এক নতুন সুযোগ।

“জল শুধু জীবন নয়—এটি এক বৈশ্বিক সম্পদ। এর মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও ব্র্যান্ডিংয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারে।” — আলহাজ কবীর আহমেদ ভূঁইয়া

‘ব্লু-গোল্ড’ যাত্রা শুরু হোক এখানেই, এখনই।

লেখক : চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া ফাউন্ডেশন। রাজনৈতিক ও উন্নয়ন কৌশলবিদ।