তেহরানের ভাণ্ডারে এমন অস্ত্র আছে যা কখনোই ব্যবহার করা হয়নি : ইরানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী

ইরানের এই বার্তা কেবল ইসরাইলের জন্যই নয়, বরং তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির জন্যও সতর্কসংকেত। কারণ ভবিষ্যতের যেকোনো সংঘাতে ইরান যদি পূর্ণ সামরিক শক্তি ব্যবহার করে, তবে শুধু আঞ্চলিক ভারসাম্য নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তাও নতুন সংকটে পড়তে পারে।

সৈয়দ মূসা রেজা
ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিরজাদেহ
ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিরজাদেহ |সংগৃহীত

ইসরাইলের চাপিয়ে দেয়া ১২ দিনের যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে এমন এক শক্তির ইঙ্গিত দিলেন, যা এখনো ব্যবহার করা হয়নি। তার ভাষায়, ‘ইরানের হাতে নিশ্চিতভাবেই এমন হাতিয়ার আছে, যা এখনো ব্যবহার করা হয়নি। সম্প্রতি ইহুদিবাদী ইসরাইলের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ইরান তার অত্যাধুনিক যুদ্ধ-সরঞ্জাম ব্যবহার করেনি। এসব যুদ্ধ-সরঞ্জামের অন্যতম হলো ক্ষেপণাস্ত্র।’

ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন দেশটির সরকারি বার্তাসংস্থা ইরনার বরাত দিয়ে জানায়, প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, ইরানের অগ্রাধিকার কেবল ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বলেন, ‘ইরানে অন্যান্য অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রও রয়েছে। যদি চাপিয়ে দেয়া ১২ দিনের যুদ্ধ স্থলভূমি কিংবা সাগরে ছড়িয়ে পড়ত, তবে ইরান নিজ অস্ত্র ভাণ্ডারের অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ইরানের পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকার নির্ধারিত রয়েছে। আর এ যুদ্ধে অর্জিত অভিজ্ঞতা ইরানের জন্য অগ্রাধিকারের নতুন ক্ষেত্রও তৈরি করেছে।’

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিরজাদেহ এরপর ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার সামগ্রিক চিত্র ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “পৃথিবীর কোথাও শতভাগ অজেয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো তথাকথিত শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘প্যাট্রিয়ট’ ও ‘আয়রন ডোম’। এগুলো দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র ভৌগোলিক অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও অত্যাধুনিক বলে কথিত এসব ব্যবস্থা ইরানের আক্রমণ ঠেকাতে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি।”

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি উল্লেখ করে নাসিরজাদেহ আরো যোগ করেন, ‘যুদ্ধের শুরুতে ইরানের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কিছু ক্ষতি স্বীকার করেছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ইরান বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে দ্বিতীয় সপ্তাহে ইরান ইহুদিবাদী ইসরাইলের বহু ড্রোন ভূপাতিত করতে পেরেছে। পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে সাফল্যও অর্জন করেছে। এই ভয়াবহ লড়াই ছিল যেন এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে সামরিক মহড়া বা সামরিক প্রশিক্ষণ। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এই যুদ্ধ এক অমূল্য অভিজ্ঞতা, যা নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য কেবল যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির এক বিশ্লেষণ নয়, বরং আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করছে। মধ্যপ্রাচ্য বহু দশক ধরে ইসরাইল ও তার মিত্রদের সামরিক প্রভাববলয়ে ছিল। ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে তেল-সমৃদ্ধ এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে এবং ইসরাইলকে উন্নত প্রযুক্তি, বিশেষ করে আয়রন ডোম ও প্যাট্রিয়ট–এর মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সহায়তা করেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, ইসরাইলের প্রচলিত প্রতিরক্ষা কাঠামো আর অভেদ্য বা অজেয় নয়। গাজার প্রতিরোধযোদ্ধারা ক্ষুদ্র ভৌগোলিক পরিসরে থেকেই এমন সব হামলা চালিয়েছে, যা উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বেহুলার বাসর ঘরে পরিণত করেছে। অর্থাৎ প্রতিরক্ষা বলয় ভেদ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। ইরান এই বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এসে বলছে, যদি সরাসরি সংঘাত দীর্ঘায়িত হয়, তবে তেহরানের হাতে আরো শক্তিশালী ও অপ্রকাশিত অস্ত্রভাণ্ডার আছে, যা আঞ্চলিক ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।

ইসরাইল বহু বছর ধরে দাবি করে আসছে, তেল আবিব আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ কার্যকর। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এই সিস্টেম ব্যয়বহুল ও সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন। একই সময়ে অল্প খরচে তৈরি রকেট বা ড্রোন নিক্ষেপ করা হলে সিস্টেম দ্রুত ভেঙে পড়ে। এ কারণেই প্রতিরোধযোদ্ধারা ধারাবাহিক ও ব্যাপক হামলা চালিয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে। ইরানিরা মনে করছে, যদি তাদের আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, তবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর গতি, পাল্লা ও নিখুঁত আঘাতের ক্ষমতা আয়রন ডোম–এর জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হবে।

ইরান দীর্ঘদিন ধরেই নিজেকে পশ্চিম এশিয়ার প্রতিরোধ অক্ষের কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ, ফিলিস্তিনের বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠী- সবাই কোনো না কোনোভাবে ইরানের কৌশলগত সহায়তায় উপকৃত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তেহরান শুধু সামরিক নয়, বরং রাজনৈতিকভাবেও নিজেকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০–৮৮) ইরানকে সামরিক আত্মনির্ভরশীলতার পথে ঠেলে দেয়। সে সময় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও অস্ত্র অবরোধ ইরানকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে বাধ্য করে। আজ তারই ফলে তেহরান উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তাই ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য শুধু সাম্প্রতিক যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং চার দশকের সামরিক সংগ্রামের আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যখন বলেন, ‘আমাদের হাতে এমন অস্ত্র রয়েছে যা এখনো ব্যবহার করা হয়নি,’ তখন এটি শুধু এক সামরিক গোপনীয়তার ইঙ্গিত নয়, বরং আঞ্চলিক প্রতিপক্ষদের উদ্দেশে স্পষ্ট বার্তা। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত যতই তীব্র হোক, ইরান জানিয়ে দিলো- তার হাতে এখনো ‘অপ্রকাশিত শক্তি’ মজুত আছে।

এই বার্তা কেবল ইসরাইলের জন্যই নয়, বরং তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির জন্যও সতর্কসংকেত। কারণ ভবিষ্যতের যেকোনো সংঘাতে ইরান যদি পূর্ণ সামরিক শক্তি ব্যবহার করে, তবে শুধু আঞ্চলিক ভারসাম্য নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তাও নতুন সংকটে পড়তে পারে।

এভাবে দেখা যায়, ১২ দিনের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধটি শুধু এক ক্ষণস্থায়ী সংঘাত নয়; বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ও কৌশলগত সমীকরণে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য সেই নতুন অধ্যায়ের অগ্রদূতস্বরূপ।