অলি বারবার ফিরে আসে- ফুল বিকাশে সে কথাই বলে। কিন্তু ইরানে কিছু চোর যে বারবার জেলে গিয়েও ফের চুরি করতে নামে, তার পেছনে নেই কোনো কবিতার সহজ ব্যাখ্যা।
তেহরান থেকে বার্তাসংস্থা ইরনার প্রতিবেদন বলছে, পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটিতে চুরির হার কিছুটা কমেছে ঠিকই। কিন্তু একইসাথে এটা স্পষ্ট যে কেবল শাস্তি দিয়ে অপরাধকে দমন করা সম্ভব নয়, বিশেষত যখন সমাজে অপরাধীর পুনঃস্থাপনের কোনো কাঠামোই ইরানে নেই।
ঘুরে দাঁড়ানোর বদলে ঘুরে ফিরে আবার চুরি
ইরানি খবরে মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে, ‘আবারো ধরা পড়ল সেই পুরোনো চোর!’ বারবার শাস্তি পাওয়া সত্ত্বেও কেউ চুরিতে কেনো ফিরে যায়? আইন কি যথেষ্ট ভয় দেখাতে পারে না? নাকি গল্পটা আরো জটিল?
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, নব্বইয়ের দশকে ইরানে চুরির সংখ্যা বেড়েছিল, যার সর্বোচ্চ ছিল ২০২১ সালে। সে বছর প্রায় ১০ লাখ ১৪ হাজার চুরির মামলা হয়। তবে এরপর ধীরে ধীরে চুরির হার কমেছে। ২০২২ সালে চুরি ৭.৮ শতাংশ কমেছে এবং ২০২৪ আরো ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
চলতি বছর নওরোজ উৎসবের সময়ে চুরির হার কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে গাড়ি চুরি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। পুলিশ জানিয়েছে, মোট চুরির ৮০ শতাংশ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তাতেও একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যায়, এই চোরদের অর্ধেকই আগেও চুরির দায়েই কারাগারে গিয়েছিল।
ক্ষুধার ভয় জেলের ভয়কে হার মানায়
ইরনার প্রতিবেদককে দেশটির সমাজতাত্ত্বিক সেদিকা খোসরাভানি জানিয়েছেন, ‘বেশিভাগ চোর চুরি করে লোভে নয়, চুরি করে গরিবির তাড়নায়। যেসব এলাকায় দারিদ্র্য প্রকট, সেখানে মানুষ শুধু আয়হীন নয়- তারা শিক্ষার, চিকিৎসার ও চাকরির সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।’
যাদের বসবাস গরিব পাড়ায়, যাদের নেই শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা পেশাগত দক্ষতা, তাদের কাছে চুরি হয়ে ওঠে বাঁচার একমাত্র উপায়। এমনকি সমাজে ‘সফল’ হওয়ার পথও হয়ে দাঁড়ায় সেটা। খোসরাভানি বলেন, ‘যখন একজন মানুষের ঘরে খাবার থাকে না, চিকিৎসা নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তখন তার কাছে জেলের ভয় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তার চেয়ে ক্ষুধার ভয় বড় হয়ে ওঠে।’
এই পরিবারগুলোতে বড় হওয়া শিশুরাও দেখে, জীবন চালাতে হলে ‘আনুষ্ঠানিক পথ’ নয়, চতুরতা আর ‘ছোটখাটো চুরি’ই যেনো বাস্তব পথ। এটাই তাদের কাছে হয়ে ওঠে ‘স্বাভাবিক’।
শাস্তি নয়, চাই পুনর্বাসন ও জীবনের শিক্ষা
শাস্তি মানবসভ্যতার প্রাচীনতম আইনি অস্ত্র। জেল, বেত্রাঘাত, জরিমানা- সবই তাৎক্ষণিকভাবে ভয় তৈরি করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা অনেক সময়েই ব্যর্থ হয়। খোসরাভানির মতে, ‘যে সমাজে মানুষকে কেবল শাস্তি দেয়া হয়, কিন্তু জীবন চালানোর পদ্ধতি শেখানো হয় না, সেখানে শাস্তি একজন অপরাধীকে কেবল অপরাধীই করে তোলে, তাকে নাগরিক বানায় না।’
তিনি বলেন, ‘চুরি করে ধরা পড়া ব্যক্তি যদি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে বা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে সে আবারো অপরাধে ফিরবেই।’ প্রতিটি শাস্তির যেন মূল্যায়ন করা দরকার—অপরাধী যদি ভাবে, ‘চুরি করে যা পাবো, তার তুলনায় জেল বা সামাজিক অপমান কিছুই নয়,’ তাহলে সে আর থামবে না।
চুরি যখন পরিচয় হয়ে ওঠে
খোসরাভানি জানান, চুরি অনেকের কাছে শুধু অপরাধ নয়, এক প্রকার পরিচয়। বিশেষ করে সংঘবদ্ধ চক্র বা ঝুঁকিপূর্ণ পাড়ার ক্ষেত্রে, চোর হওয়ার পরিচয়েই তৈরি হয় একটা গোষ্ঠীবদ্ধ সম্মান। “জেলে গিয়ে কেউ হয় ‘দারুণ হাতের কারিগর’, কেউ ‘দারুণ ফুর্তিবাজ’- এই পরিচয়ের মধ্যে জন্ম নেয় শক্তি, শ্রদ্ধা, গোষ্ঠীবোধ। আর এসব পাওয়া যায় না ন্যূনতম মজুরির চাকরিতে বা নামকা ওয়াস্তে পুনর্বাসন প্রকল্পে।”
এই পরিচয়ের জন্যই অনেকে নিজের পেশা হিসেবেই বেছে নেয় চুরি। তারা এটিকে ‘ব্যক্তিত্ব’ ও ‘সম্মানের’ বিষয় মনে করে।
যখন বড় দুর্নীতি ছোট চুরির ন্যায্যতা তৈরি করে
খোসরাভানি আরো বলেন, ‘যখন দেখা যায়, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেও কেউ শাস্তি পায় না, সম্পত্তিও ফেরত দিতে হয় না, তখন সাধারণ মানুষের মনে তৈরি হয় একটাই ধারণা- আইনের শাসন সবার জন্য সমান নয়।’ ফলে ‘চুরি খারাপ’ এই সামাজিক মূল্যবোধটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। আর উচ্চবিত্ত আর সাধারণ মানুষের মধ্যকার আয়-বৈষম্য যখন দিন দিন বাড়ে, তখন ‘আমি কেনো নয়?’ এই ভাবনা ছোটখাটো অপরাধকে বৈধ করে তোলে। তাই কেবল ছোট চুরির বিরুদ্ধে লড়াই যথেষ্ট নয়। বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সমানভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যেনো সমাজে আইনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
জেলের বাইরে ফিরে আসা মানেই শুরু নয়, বরং ফেরা পুরোনো পথে
ফারাজাহ পুলিশের কর্নেল মোহাম্মদ শরিফি বলেন, ‘একজন চোর জেল খেটে যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে সমাজে ফিরে আসে খালি হাতে, রক্তাক্ত আত্মা নিয়ে, আর তার কপালে দাগী তকমা সেটে দেয়া হয়।’ ফলে সমাজ তাকে গ্রহণ করে না। চাকরির বাজার তাকে ফিরিয়ে দেয়। এমনকি সাধারণ সম্পর্কে ক্ষেত্রেও তার ওপর থাকে সন্দেহের দৃষ্টি।
এই পরিস্থিতিতে, ‘ভুলি মান অপমান’ চুরি ছাড়া তার আর কী-ই বা করার পথ থাকে? শরিফির মতে, একে কেবল ‘অভ্যাস’ বলা ভুল, বরং এটা একপ্রকার ‘নিরুপায়তা’। প্রকৃত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া কারাগার হয়ে পড়ে অপরাধীর প্রশিক্ষণশালা, যেখানে সে আরও দক্ষ হয়ে ফিরে আসে। প্রচলিত কথা হলো, চোর হয়ে ঢোকে ডাকাত হয়ে বের হয়ে বের হয়ে আসে।
শুধু জেল নয়, চাই কর্মসংস্থান আর দক্ষতা শেখানো
ইরানের বিচার বিভাগের প্রথম উপপ্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ও আল মুসলিম হামজা খালিলি বলেন, ‘যদি একজন কয়েদি জেল থেকে বেরিয়ে কাজ করতে পারেন, উদ্যোক্তা হতে পারেন, তবেই আমরা সফল। তবেই সে আর ফের জেলে ফিরবে না।’
বর্তমানে ইরানে প্রায় ৪২ হাজার কয়েদি কাজ করছেন, যাদের ১৭ কয়েদি কর্মরত বিভিন্ন কারখানায়। কিন্তু তাদেরকে প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মেলানো দক্ষতা শেখানোয় ঘাটতি রয়েছে। অনেক প্রশিক্ষণই বাজারের চাহিদা মেটায় না। ফলে জেল থেকে বেরিয়ে বৈধ চাকরিতে ঢোকার সুযোগ কমে যায়। এছাড়া, দক্ষতা না থাকা, মানসিক অসুস্থতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি- সব মিলিয়ে অনেকেই আবারো সেই কাজেই ফেরে, যা সে ‘ভালো’ পারে- চুরি।
শাস্তির পথ দিয়ে পরিবর্তন আসে না, আসে সামাজিক সুবিচার দিয়ে
এই দীর্ঘ প্রতিবেদনের সারকথা একটাই- চুরি বন্ধ করতে হলে কেবল জেলের ভয় দেখিয়ে চলবে না। দরকার শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পুনর্বাসন, আর সবচেয়ে বড় কথা- একটা ন্যায্য সমাজ। না হলে জেলের দেয়াল যতই উঁচু হোক, দাগী চোরেরা ঠিকই ফিরে আসবে। আর গানের অলি যেমন বারবার ফেরে তার ফুলের খোঁজে, ওরাও ফিরে আসবে সেই পথেই- যা তাদের একমাত্র চেনা পরিচয়।