তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও জনজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বল্পতা এবং বর্ষায় অতিরিক্ত প্রবাহ বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি বড় সমস্যা হয়ে আছে। বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীর পানি সমস্যার সমাধানের জন্য ‘তিস্তা মেগা প্রকল্প’ গ্রহণ করেছে, যেখানে চীনের সহায়তা নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু ভারত এই প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
ভারতের আপত্তির কারণ
১. ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান। বাংলাদেশে চীনের বড় ধরনের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব আরো বাড়িয়ে দেবে।
চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উপস্থিতি জোরদার করতে চাইছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পের অংশ হিসেবে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ভারতকে আরো বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
২. নিরাপত্তাসংক্রান্ত উদ্বেগ : তিস্তা নদী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়, যা দেশের অন্যতম সংবেদনশীল অঞ্চল। যদি চীন বাংলাদেশে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে, তবে ভারত মনে করে এটি ভবিষ্যতে তাদের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ভারতের ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেনস নেক’ খুব সঙ্কীর্ণ একটি ভূখণ্ড যা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করে। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে, চীনের উপস্থিতি এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
৩. পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি : ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেয়ার বিপক্ষে। তার যুক্তি হলো এতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও এই প্রকল্প নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাথে বিরোধে জড়াতে চায় না, যা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখা : ভারত বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশে। চীনা প্রকল্প সফল হলে, বাংলাদেশ ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকতে পারে।
চীন বাংলাদেশকে ভারত থেকে বেশি আর্থিক সহায়তা দিতে পারে, যা ভারতের অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
৫. পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা : ভারত বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর না করলেও এই নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশ যদি চীনের সাহায্যে নিজস্ব পানি ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা অর্জন করে তাহলে ভারত এখানে তার কূটনৈতিক প্রভাব হারাতে পারে। এ ছাড়া ভারত আশঙ্কা করছে, বাংলাদেশ এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোও চীনের সাহায্য নিতে পারে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে বলেই তিস্তা নদী প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতের আপত্তি মূলত ভূরাজনৈতিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে। ভারত চায় না যে, বাংলাদেশের কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পে চীন গভীরভাবে জড়িত হোক। এ সঙ্কট সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে এবং ভারতের উদ্বেগ দূর করার পাশাপাশি দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
তবে শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় আনতে ভারত যে মনোভাব দেখাচ্ছে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিরামহীন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতকে এটি গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন, গুম, খুন এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের পর, বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে ভারতকে শেখ হাসিনার সময়ের আধিপত্যবাদী আচরণের পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে নতুন আঙ্গিকে সম্পর্ক স্থাপনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বুঝতে হবে বাংলাদেশের মানুষ ভারতবিরোধী নয়, ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধী।



