তেহরানের আকাশে ধোঁয়ার রেখা : নারীদের সিগারেট সংস্কৃতি এবং সমাজের অচেনা রূপ

যে দেশে ইসলামি শাসনের দৃঢ়তা, সামাজিক নিয়ম-কানুনের কঠোরতা নিয়ে বিশ্বপরিচিত, সেই দেশেই নারীরা প্রকাশ্যে সিগারেট ধরাচ্ছেন। কেউ কেউ একে সামাজিক বিকাশের চিহ্ন বলছেন, আবার কেউ দেখছেন সামাজিক ক্ষতির সতর্কবার্তা হিসেবে।

সৈয়দ মূসা রেজা

বাংলা কবিতায় আমরা অনেক আগে থেকেই বিলেতি অনুকরণকে বিদ্রূপ করে আসছি। সেই বহুল আলোচিত কবিতার পঙ্‌ক্তি মনে পড়ে- ’আমরা বিলিতি ধরনে হাসি/আমরা ফরাসি ধরনে কাশি/আমরা পা ফাঁক করে সিগারেট খেতে/বড্ডই ভালোবাসি।’

সেই ব্যঙ্গের ছায়া আজ যেন বাস্তবে ফুটে উঠছে একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে- ইরানে। বহু সহস্রাব্দের ইতিহাসের ধারক-বাহক, ইসলামী শাসনের দৃঢ় কেন্দ্রস্থল এই দেশ এখন দাঁড়িয়ে নতুন এক সামাজিক সংকেতের সামনে। ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন-এর খবরে জানানো হয়েছে, ইরানের নারীকূলের মধ্যে ধূমপান দ্রুত বাড়ছে, আর সেটি শুধু সিগারেট নয়- হুক্কা থেকে ভেপ পর্যন্ত বিস্তৃত।

রাস্তায় রাস্তায় ধোঁয়ার ছবি

ইরানের শহুরে চিত্র আজ ভিন্ন। সন্ধ্যার ভিড়ভাট্টায় পার্কে বসা বা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অনায়াসে সিগারেট ধরাচ্ছেন নারীরা। সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সিগারেট সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। রাস্তার সংবাদপত্রের স্টলগুলো আজ সংবাদপত্রের চেয়ে বেশি বিক্রি করছে সিগারেট। তুলনামূলক সস্তা দাম, আকর্ষণীয় প্যাকেটের মোড়ক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর স্থানীয় ধারাবাহিকে ধূমপানকে বারবার প্রদর্শন- সবকিছু মিলে নারীদের কাছে ধূমপান এখন আর নিষিদ্ধ নয়, বরং একধরনের ‘সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি’। কিশোরীরা অল্প টাকায় দিনে এক থেকে দু’টো সিগারেট কিনে নিতে পারছে অনায়াসে। আর সেখান থেকেই তৈরি হচ্ছে অভ্যাস।

ভয়াবহ পরিসংখ্যান: কিশোরীদের ধূমপান বেড়েছে ১৩০ শতাংশ

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে সিগারেট খাওয়ার হার বেড়েছে ১৩০ শতাংশেরও বেশি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় একটি সিগারেট পেতে গড়ে ৪৫ মিনিট সময় লাগে, সেখানে ইরানে মুহূর্তের মধ্যেই তা পাওয়া যায়। তরুণ প্রজন্মের এই প্রবণতা শুধু ধূমপানেই সীমাবদ্ধ নয়। সিগারেটের পাশাপাশি হুক্কা, নেশাদ্রব্য মেশানো গাঁজাজাতীয় পদার্থ, এমনকি ভেপেরও ব্যবহার বাড়ছে। যদিও ভেপকে অনেকেই ‘নিরাপদ’ মনে করেন, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন- ভেপ মোটেও প্রচলিত সিগারেটের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়।

বিশেষজ্ঞদের চোখে সংকেত

হামশাহরি অনলাইন-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে আসক্তি গবেষক ও ইরানের মাদকবিরোধী সদর দপফতরের সাবেক মহাপরিচালক ডক্টর সাঈদ সেফাতিয়ান বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি অস্বীকার করার উপায় নেই। সামাজিক মঞ্চ হোক বা বন্ধঘর- সবখানেই এর প্রমাণ মিলছে।’

গত বছর যে দোকানি অল্প কয়েকজন নারী ক্রেতাকে সিগারেট বিক্রি করেছিলেন, এ বছর তার ক্রেতা কয়েকগুণ বেড়েছে। তিনি মনে করেন, বিষয়টি একদিকে সামাজিক ক্ষতি হলেও অন্যদিকে এটিকে একধরনের সাব-কালচার বা উপসংস্কৃতি হিসেবেও দেখা যেতে পারে, যা সমাজ বিকাশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ইউরোপের ইতিহাস, ইরানের বর্তমান

সেফাতিয়ান জানান, ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে সিগারেট প্রথম জনপ্রিয়তা পায় উচ্চবিত্ত সমাজে। ধীরে ধীরে তা নেমে আসে শ্রমজীবী মানুষ ও নারীদের মধ্যেও। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত নারী ধূমপান ছিল একপ্রকার নিষিদ্ধ বিষয়। কিন্তু সময়ের প্রবাহে তা ভেঙে পড়ে, আজ আর সেটি সেখানে ট্যাবু নয়। ইরানেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে। সামাজিক পরিবর্তন, কৌতূহল, ভোগবাদী মনোভাব আর পারিবারিক প্রভাব- সবমিলেই নারীদের ধূমপানের দিকে টেনে আনছে।

বয়স কমছে, ধোঁয়া বাড়ছে

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ এবং ১৮ বছরের নিচে প্রায় পাঁচ শতাংশ তামাক ব্যবহার করেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ২৬ শতাংশ হলেও নারীদের মধ্যে তা পাঁচ শতাংশ। কিন্তু সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, বয়স কমছে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা ২২ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যেই ধূমপান দেখা যেত। এখন সন্ধ্যায় তেহরানের পার্কগুলোতে গেলে দেখা যায়, ১০ জন স্কুলপড়ুয়া মেয়ের মধ্যে দুই থেকে তিনজন ধূমপান করছে।

কিশোর মনস্তত্ত্ব: আনন্দ, কৌতূহল আর অনুকরণ

ডক্টর সেফাতিয়ান বিশ্লেষণ করেছেন, কিশোরদের ধূমপানের তিনটি প্রধান কারণ- ভোগবাদী আনন্দের খোঁজ, কৌতূহল,পারিপার্শ্বিক অনুকরণ। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো কিশোর দেখে, তার মা নার্ভাস হলে সিগারেট ধরাচ্ছেন, কিংবা বাবা ফুটবল ম্যাচে গোল করার আনন্দে সিগারেট টানছেন, তবে সে নিজেও কৌতূহলী হবে। কৌতূহল থেকে একসময় অভ্যাস তৈরি হয়।’

অভাব জীবন দক্ষতার, অসম্পূর্ণ সামাজিক বিকাশ

সেফাতিয়ান আরো বলেন, ১৯৫০ থেকে ৬০-এর দশকের অনেক বাবা-মা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বড় হয়েছেন। তাই তারা এখন বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের সন্তানরা সবকিছু অভিজ্ঞতা করুক।’

এটিও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের অংশ। কিন্তু সমস্যা হলো- এর সাথে জীবন দক্ষতার কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না। ইউরোপে সাংস্কৃতিক বিকাশের পাশাপাশি স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সামাজিক সংগঠনগুলো কিশোর-কিশোরীদের জীবন দক্ষতা শেখাত। কিন্তু ইরানে সেই দিকটি একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে কিশোরীরা অভিজ্ঞতা নিতে গিয়ে বিপজ্জনক অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ছে।

ধোঁয়ার আড়ালে অচেনা সমাজ

ইরান আজ যেন ইতিহাসের এক নতুন মোড়ে। যে দেশে ইসলামি শাসনের দৃঢ়তা, সামাজিক নিয়ম-কানুনের কঠোরতা নিয়ে বিশ্বপরিচিত, সেই দেশেই নারীরা প্রকাশ্যে সিগারেট ধরাচ্ছেন। কেউ কেউ একে সামাজিক বিকাশের চিহ্ন বলছেন, আবার কেউ দেখছেন সামাজিক ক্ষতির সতর্কবার্তা হিসেবে। কিন্তু যে সত্যটি অস্বীকার করার উপায় নেই তা হলো- তেহরানের সন্ধ্যাকাশে এখন ধোঁয়ার রেখা শুধু তামাকের নয়, বরং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও প্রতীক। একসময় যে ব্যঙ্গ কবিতার পঙ্ক্তিতে ধরা পড়েছিল, আজ তা রূপ নিয়েছে এক বাস্তব সামাজিক কাহিনিতে- ‘আমরা বিলিতি ধরনে হাসি…আমরা ফরাসি ধরনে কাশি…।’