মধ্যপ্রাচ্য আজ এক সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। ইসরাইলের যুদ্ধবিমান ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার গভীরে আঘাত হেনেছে। হত্যা করেছে শীর্ষ বিজ্ঞানী ও জেনারেলদের। প্রতিশোধে তেহরানের রাতের আকাশ থেকে ছুটে গেছে শত শত ড্রোন ও ব্যালিস্টিক মিসাইল। যার লক্ষ্য ইসরাইলের ভূখণ্ড। ইরানের বহুমাত্রিক আক্রমণে থমকে গেছে ইসরাইল।
বিশ্বের চোখ যখন তেল আবিব, তেহরান আর ওয়াশিংটনের দিকে তখন হাজার হাজার মাইল দূরে মস্কোর ক্রেমলিনে বসে আছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি এই খেলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিতে পারেন।
তার টেবিলে রাখা টেলিফোনটি বেজে চলেছে। এক প্রান্তে তিনি কথা বলছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতায়াহুর সাথে অন্য প্রান্তে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সাথে। তিনি ভ্লাদিমির পুতিন এবং তিনি আজ এক অবিশ্বাস্য রকমের জটিল ও বিপদজ্জনক দাবার চাল চালছেন।
ইরান ও ইসরাইলের এই সরাসরি সংঘাতে রাশিয়ার ভূমিকা কি? এই প্রশ্নটি আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রাশিয়া কি কেবল একজন নিরপেক্ষ শান্তিদূত? যে তার পুরনো বন্ধু ইসরাইল এবং নতুন কৌশলগত মিত্র ইরান উভয়কে শান্ত করার চেষ্টা করছে? নাকি একজন ধূর্ত সুযোগসন্ধানী? যে এই সংঘাতের আগুন থেকে নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে অথবা আরো ভয়ঙ্কর কিছু। এই আগুন কি তিনি নিজেই পর্দার আড়াল থেকে উস্কে দিচ্ছেন?
এই গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতা, কৌশলগত পরাজয় এবং নতুন মিত্রতার কাহিনী। কারণ, মাত্র কয়েক মাস আগেই ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় রাশিয়ার এক দশকের বিনিয়োগ এবং ইরানের সব প্রচেষ্টা ধুলোয় মিশে গেছে বাশার আল আসাদের সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। এই পরাজয় মস্কো ও তেহরানকে একে অপরের আরো কাছে ঠেলে দিয়েছে। তৈরি করেছে এক নতুন এবং আরো বিপদজ্জনক অক্ষশক্তি, যা জানুয়ারি ২০২৫ সালে দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
আজ আমরা ডুব দেবো একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের গভীরে। আমরা বিশ্লেষণ করব কিভাবে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন এবং ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। আমরা দেখব পুতিন কিভাবে একদিকে ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন। অন্যদিকে নেতানিয়াহুকে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিচ্ছেন।
রাশিয়ার বর্তমান অবস্থান বোঝার জন্য আমাদের সেই পুরনো ত্রিভুজকে ভুলে যেতে হবে। যেখানে রাশিয়া, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে একটি সূক্ষ ভারসাম্য ছিল। সেই ভারসাম্য রক্ষার আয়নাটি ভেঙে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের আকস্মিক পতন ছিল সেই আয়নার উপর শেষ আঘাত। আজ রাশিয়া এক নতুন, আরো ভঙ্গুর এবং বিপদজ্জনক বাস্তবতার মুখোমুখি। রাশিয়া ও ইরানের বর্তমান সম্পর্ককে এখন আর শুধু প্রয়োজনের বন্ধুত্ব বলা চলে না। এটি এখন অস্তিত্বের প্রয়োজনে তৈরি হওয়া জোট।
একসময় তাদের সম্পর্ক ছিল মূলত কমন শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার ওপর ভিত্তি করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তারা একসাথে বাশার আল আসাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করেছে। রাশিয়া আকাশ থেকে শক্তি যুগিয়েছে। আর স্থলভাগে ইরান ছিল তার প্রক্সি বাহিনী নিয়ে। কিন্তু দু’টি ঘটনা এই সম্পর্ককে নতুন করে আরো গভীর স্তরে নিয়ে গেছে।
প্রথমত ইউক্রেন যুদ্ধ। ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু করার পর রাশিয়া যখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত, তখন অস্ত্রের সংকটে ইরান হয়ে ওঠে তাদের লাইফলাইন। ইরান রাশিয়াকে হাজার হাজার সাহেদ ১৩৬ কামি কাজের ড্রোন সরবরাহ করে, যা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই ড্রোনগুলোর প্রযুক্তি রাশিয়া নিজেও এখন ব্যবহার করছে।
দ্বিতীয়ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিরিয়ায় যৌথ পরাজয়। এক দশক ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়ে এবং ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেও রাশিয়া আসাদ সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বিদ্রোহীদের ঝটিকা অভিযানে আসাদের পতন ছিল মস্কো ও তেহরান উভয়ের জন্যই এক বিরাট কৌশলগত এবং সম্মানহানিকর পরাজয়। এই পরাজয় তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে পশ্চিমের বিরুদ্ধে একা লড়াই করা কতটা কঠিন।
এই যৌথ ব্যর্থতার ছাই থেকে জন্ম নিয়েছে তাদের নতুন সম্পর্ক। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুতিন ও পেজেশকিয়ান যে কম্প্রিহেন্সিভ স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ বা কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন তা এখন আর কোনো সাধারণ চুক্তি নয়। এটি হলো দু’টি বিচ্ছিন্ন এবং কোণঠাসা শক্তির একে অপরকে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকার দলিল। এই চুক্তির অধীনে ইরান এখন রাশিয়ার কাছ থেকে সেইসব অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি আশা করছে যা পাওয়ার জন্য তারা দশকের পর দশক ধরে অপেক্ষা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সুখোই সু যুদ্ধবিমান এবং এস ফোর হান্ড্রেডের মতো অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
যদিও অতীতে ইসরাইলের উদ্বেগের কারণে রাশিয়া এই অস্ত্রগুলো সরবরাহ করতে দ্বিধা করেছে। কিন্তু আজকের নতুন বাস্তবতায় সেই দ্বিধা অনেকটাই কেটে গেছে। কারণ সিরিয়া হারানোর পর মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব ধরে রাখার জন্য ইরানই এখন তার শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি।
একসময় রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে একটি অত্যন্ত কার্যকরী তবে অলিখিত বোঝাপড়া ছিল। এর ভিত্তি ছিল দু’টি। সিরিয়ার আকাশে ডিকনফ্লিকশন মেকানিজম এবং পুতিন ও নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রসায়ন।
আসাদের পতনের সাথে সাথে এর প্রথম ভিত্তিটি ধসে পড়েছে। সিরিয়ার আকাশ আর রাশিয়ার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে ইসরাইলকে এখন আর সিরিয়ায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর আগে মস্কোর সবুজ সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। কিন্তু তার মানে এই না যে রাশিয়ার প্রভাব পুরোপুরি শেষ।
সিরিয়ায় এখনো নৌ ও বিমান ঘাঁটি রয়েছে রাশিয়ার। আর এই নতুন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সংঘাতের ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক বেশি। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে এসেছে শীতলতা।
রাশিয়া প্রকাশ্যে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধে রাশিয়াকে সরাসরি সাহায্য করছে ইরান। এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলের পক্ষে রাশিয়ার সাথে আগের মতো উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন। তবুও সম্পর্কটি এখনো পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। এর প্রধান কারণ সূক্ষ্ম কূটনৈতিক চাল।
ইসরাইল এখনো পর্যন্ত ইউক্রেনকে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ করা থেকে বিরত থেকেছে যা মস্কো কৃতজ্ঞতার সাথে লক্ষ্য করেছে। এছাড়া ইসরাইলে বসবাসকারী বিশাল রুশভাষী জনগোষ্ঠী এখনো দুই দেশের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করে।
সাম্প্রতিক সংঘাতে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া এই জটিলতারই প্রতিফলন। ইসরাইলের হামলার পর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে কঠোর ভাষার বিবৃতি দিয়েছে এবং সব পরিণতির জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছে তা ছিল মূলত ইরান ও আরব বিশ্বকে দেখানোর জন্য।
কিন্তু একইসাথে পুতিন ব্যক্তিগতভাবে নেতানিয়াহুকে ফোন করে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে রাশিয়া এখনো ইসরাইলের সাথে যোগাযোগের চ্যানেলটি খোলা রাখতে চায়। এটা স্পষ্ট যে এই সম্পর্ক এখন আর আগের মত বন্ধুত্বের নয় বরং সংকট ব্যবস্থাপনার এক ভঙ্গুর প্রচেষ্টা মাত্র। ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত মস্কোকে একটি অস্বস্তিকর অবস্থানে ফেললেও পুতিনের জন্য এটি এক বিরাট সুযোগও বটে।
ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধা করতে না পারা এবং সিরিয়ায় অসম্মানজনক পরাজয়ের পর পুতিন এখন এই নতুন সংকটকে ব্যবহার করে তার ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছেন। তার বর্তমান কৌশলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। এটি রাশিয়ার বর্তমান প্রধান কৌশল। প্রকাশ্যে পুতিন একজন দায়িত্বশীল বিশ্বনেতার ভূমিকা পালন করছেন। তিনি নেতানিয়াহু ও পেজেশকিয়ান উভয়ের সাথেই কথা বলছেন। তিনি উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানাচ্ছেন এবং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এমনকি তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথেও কথা বলে তার মধ্যস্থতার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন।
এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে দেখাতে চাইছেন, রাশিয়াকে ছাড়া বিশ্বের কোনো বড় সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু পর্দার আড়ালে এই সংঘাত রাশিয়ার জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনছে।
বিশ্লেষকদের মতে এটি রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় লাভ। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, রাজনীতিবিদ ও জনগণের মনোযোগ ইউক্রেন থেকে সরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন মধ্যপ্রাচ্যে তার মিত্র ইসরাইলকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। এর ফলে কিয়েভের জন্য পশ্চিমা সামরিক ও আর্থিক সহায়তা কমে যাওয়ার একটি বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর সাফল্যকে সাহায্য করবে। এরপরে আছে তেলের দামে লাগা আগুন থেকে অর্থনৈতিক লাভ। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের অর্থ বিশ্ববাজারে তেলের দামে আগুন। ইসরাইলি হামলার পরেই তেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এটি রাশিয়ার জন্য সোনায় সোহাগা।
কারণ রাশিয়া তার যুদ্ধের খরচ চালাচ্ছে তেল ও গ্যাস বিক্রি করেই। তেলের দাম যত বাড়বে রাশিয়ার অর্থনীতি তত শক্তিশালী হবে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলোকে মোকাবেলা করা তাদের জন্য তত সহজ হবে।
মস্কোর সামরিক বিশ্লেষক রুসলান পুখব যেমনটা লিখেছেন, এটি ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সেই আশাকে ধ্বংস করে দেবে যে রাশিয়ার তেলের রাজস্ব কমে যাবে। এই কৌশলের অধীনে পুতিন আসলে চান না যে যুদ্ধটি দ্রুত শেষ হোক। তিনি চান এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বল্প-তীব্রতার সংঘাত হিসেবে চলতে থাকুক। যাতে তিনি এর ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারেন। কিন্তু একইসাথে একটি পূর্ণমাত্রার বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকিও এড়ানো যায়।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদিও বলেছে, তারা ইরানকে রাজনৈতিক সমর্থনের বেশি কিছু দেবে না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেলে এই অবস্থানও বদলে যেতে পারে।
রাশিয়া ইরানকে সাহায্য করার একটি শক্তিশালী কার্ড হাতে রেখে দিয়েছে। এই সাহায্য আসতে পারে কয়েকটি রূপে।
প্রথমত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়। রাশিয়ার স্যাটেলাইটগুলো ইসরাইলের সামরিক প্রস্তুতি বা বিমান উচ্চয়নের আগাম তথ্য ইরানকে দিয়ে সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়ত সাইবার সমর্থন এবং তৃতীয়ত যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সেইসব অত্যাধুনিক অস্ত্রের সরবরাহ যা এখন পর্যন্ত রাশিয়া আটকে রেখেছে।
যদি যুদ্ধটি দীর্ঘায়িত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে রাশিয়া হয়তো ইরানকে সুখোই সু যুদ্ধবিমান এবং এস ফোরহান্ড্রেড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি হবে পুতিনের একটি চরম পদক্ষেপ। কারণ এটি একদিকে যেমন ইরানকে ইসরাইলি বিমান হামলার বিরুদ্ধে প্রায় দুর্ভেদ্য করে তুলবে তেমনি অন্যদিকে রাশিয়া-ইসরাইল সম্পর্ককে চিরতরে ধ্বংস করে দেবে।
রাশিয়া এই ঝুঁকি তখনই নেবে যখন তারা নিশ্চিত হবে যে এর বিনিময়ে তারা যুক্তারাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের চোরাবালিতে আটকে ফেলতে পারবে এবং ইউক্রেনে একটি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারবে।
এসব বিশ্লেষণ আমাদের সেই একই চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়। ভ্লাদিমির পুতিন আসলে কি চান?
উত্তরটি হলো পুতিনের লক্ষ্য ইরান বা ইসরাইল নয়। তার লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার কবর রচনা করা। ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল সেই লক্ষ্যের প্রথম ধাপ। ইরান-ইসরাইল সংঘাত তার দ্বিতীয় ধাপ।
তিনি এমন একটি বিশ্ব চান যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আর একমাত্র সুপারপাওয়ার থাকবে না। সেখানে রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজেদের প্রভাব তৈরি করতে পারবে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যস্ত রাখা, দুর্বল করা এবং তার সম্মানহানি করাটা অপরিহার্য। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এই কাজে তাকে নিখুঁতভাবে সাহায্য করছে। যেমন- এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি উভয় সংকটে পড়েছে। যদি তারা সরাসরি ইসরাইলকে রক্ষা করতে যুদ্ধে জড়ায় তাহলে তারা একটি অন্তহীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। আর যদি তারা যথেষ্ট সাহায্য না করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্ররা, যেমন সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
উভয়ক্ষেত্রেই আমেরিকার প্রভাব খর্ব হবে।
এদিকে এই সংকট ইরানকে রাশিয়ার আরো কাছে নিয়ে এসেছে এবং চীনকেও এই সমীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিয়েছে। এই তিনটি দেশ একসাথে পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি বিকল্প তৈরি করার চেষ্টা করছে।
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এই নতুন জোটকে আরো শক্তিশালী করার একটি উপলক্ষ্য মাত্র। এছাড়া এই সংকটে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার প্রস্তাব দিয়ে পুতিন জি সেভেন এবং পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের বাকি দেশগুলো অর্থাৎ গ্লোবাল সাউথকে এই বার্তা দিচ্ছেন যে বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য রাশিয়া একটি অপরিহার্য শক্তি।
সুতরাং পুতিনের কাছে ইরান-ইসরাইল সংঘাত পশ্চিমের বিরুদ্ধে তার বৃহত্তর যুদ্ধের একটি নতুন ও অত্যন্ত সুবিধাজনক ফ্রন্ট লাইন। এই খেলায় কে কতটুকু ভূখণ্ড দখল করল তার ওপর তার জয়-পরাজয় নির্ভর করছে না। বরং নির্ভর করছে এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি সম্পদ এবং সম্মান কতটা ক্ষয় হলো তার ওপর।
তাহলে আজকের প্রবন্ধের শেষে আমরা কি দেখলাম? আমরা দেখলাম, ইরান-ইসরাইল সংকটে রাশিয়া এখন আর কোনো ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি নয়। সিরিয়ায় কৌশলগত পরাজয় ও ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা তাকে একটি নতুন সুযোগসন্ধানী এবং বিপদজ্জনক ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। রাশিয়া আজ একজন দক্ষ দাবাড়ুর মতো খেলছে। প্রকাশ্যে সে শান্তির দূত কিন্তু গোপনে সেই সংঘাতের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী।
সে তার নতুন কৌশলগত মিত্র ইরানকে রাজনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু ইসরাইলের সাথেও যোগাযোগের দরজা খোলা রাখছে যাতে ভবিষ্যতে সে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই মুহূর্তে রাশিয়ার মূল লক্ষ্য এই সংঘাতকে একটি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে জিইয়ে রাখা যাতে তেলের দাম চড়া থাকে এবং ইউক্রেন থেকে বিশ্বের মনোযোগ সরে যায়। কিন্তু এই আগুন নিয়ে খেলা অত্যন্ত বিপদজ্জনক। একটি ছোট ভুল বোঝাবুঝি বা একটি অতিরিক্ত আগ্রাসী পদক্ষেপ এই নিয়ন্ত্রিত সংঘাতকে একটি পূর্ণমাত্রার আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত করতে পারে। যা রাশিয়ার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ভবিষ্যতে যে বিষয়টির ওপর আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর রাখতে হবে তা হলো, রাশিয়া থেকে ইরানে অত্যাধুনিক অস্ত্রের সরবরাহ। যদি একটি এস ফোরহান্ড্রেড সিস্টেম বা এক্স স্কোয়াড ড্রোন সুখ-৩৫ যুদ্ধবিমান তেহরানে পৌঁছায় তবে বুঝতে হবে, পুতিন তার খেলার চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করেছেন।
শেষ পর্যন্ত যখন মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে মিসাইল আর ড্রোনের আনাগোনা চলছে তখন আসল খেলাটি হয়তো মস্কোর শান্ত-শীতল করিডরে নির্ধারিত হচ্ছে। ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো কোনো বোতাম চাপবেন না। কিন্তু তার দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের দীর্ঘ ছায়া এই সংঘাতের প্রতিটি পদক্ষেপকে প্রভাবিত করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।