গার্ডিয়ানের ইউরোপ বিষয়ক প্রতিবেদক লোরেঞ্জো টন্ডো, তিনি বিশেষ করে ইতালি, ভূমধ্যসাগর অঞ্চল, অভিবাসন ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক খবর কভার করেন। ইতালির সিসিলি দ্বীপের রাজধানী শহর পালার্মো থেকে জানিয়েছেন, ইসরাইলি লেখক ডেভিড গ্রুসম্যান, যিনি একাধারে শান্তিবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিত্ব এবং ইসরাইলের সবচেয়ে সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার ‘ইসরাইল প্রাইজ’ বিজয়ী। তিনি প্রথমবারের মতো সরাসরি বলেছেন, ‘আমার দেশ ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।’
ইতালির প্রভাবশালী দৈনিক লা রেপুবলিকা-তে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে গ্রুসম্যান বলেন, ‘আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, আমরা এখানে কিভাবে পৌঁছালাম? কী করে এমন হলো যে- আমাদের মতো ইহুদিদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র অভিযোগ উঠছে? শুধুই এই শব্দটার উচ্চারণ- ‘গণহত্যা’ ইসরাইল বা ইহুদি জাতির সাথে এর সংযুক্তি, এইটুকুই আমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল। এটা প্রমাণ করে, আমাদের সাথে খুবই ভুল কিছু ঘটছে।’
ডেভিড গ্রুসম্যান বহু বছর ধরে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাননি। ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এখন, তিনি স্বীকার করেন, আর পেরে উঠছেন না। ‘সংবাদপত্রে যা পড়েছি, যেসব ছবি দেখেছি, যেসব মানুষের সাথে কথা বলেছি যারা ঘটনাস্থলে ছিলেন, তার পর আমি আর নিজেকে থামাতে পারি না। এই শব্দটা যেন এক ধ্বংসাত্মক তুষারধস : একবার বললেই সেটা বড় হতে থাকে, ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেটা আরো বেশি ধ্বংস আর যন্ত্রণার সৃষ্টি করে,’ বলেন তিনি।
এই বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি এলো এমন এক সময়ে, যখন ইসরাইলের দুটি প্রধান মানবাধিকার সংস্থা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বেতসেলেম এবং ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস–ইসরাইল বা সংক্ষেপে পিএইচআরআই স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, গাজায় ইসরাইলের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। গ্রুসম্যানও সেই একই সুরে কণ্ঠ মিলিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এই শব্দটি আমি উচ্চারণ করছি গভীর বেদনা আর এক ভাঙা হৃদয় নিয়ে।’
২০১৮ সালে ডেভিড গ্রুসম্যান ‘ইসরাইল প্রাইজ’ পান, যা ইসরাইলি সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সাহিত্যচর্চা করে এসেছেন, পাশাপাশি শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষেও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। এখন তিনি বলছেন, ‘ইউরোপের বন্ধুবান্ধবদের মুখে কিংবা পত্রিকায় যখন দেখি ‘ইসরাইল’ আর ‘ক্ষুধা’ শব্দদুটি একসাথে উচ্চারিত হচ্ছে, তখন সেটা যেন আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলে। কারণ এটা তো আমাদেরই ইতিহাস, আমাদেরই কষ্টের স্মৃতি, আমাদের মানবিক বোধের দাবি- এই তো আমরা বলি, কেবল ইহুদি নয়, প্রতিটি মানুষের প্রতি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব আছে। সেই জায়গা থেকেই এই বাস্তবতা সত্যিই ধ্বংসাত্মক।’
‘দখলদারিত্ব ইসরাইলকে নষ্ট করে দিয়েছে’
ডেভিড গ্রুসম্যান স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘দখলদারিত্ব ইসরাইলকে ভেতর থেকে পচিয়ে দিয়েছে।’ তিনি মনে করেন, ইসরাইলের এই অভিশাপের শুরু ১৯৬৭ সালের সেই সময় থেকে, যখন তারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করেছিল।
‘হয়তো মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এই প্রসঙ্গ বারবার শুনতে শুনতে, কিন্তু আমি নিশ্চিত এইটিই সত্য। ইসরাইল সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে এবং সেই সর্বশক্তির মোহে পড়ে গেছে। ইসরাইলবাসীদের মধ্যে এমন এক বোধ তৈরি হয়েছে যে তারা যা খুশি তাই করতে পারে,’ বলেন গ্রুসম্যান।
‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়া ভালো’
সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য যখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তিনি এ ব্যাপারে কী ভাবছেন?
তিনি উত্তরে বলেন, ‘আমি বরং মনে করি, এটা একটি ভালো সিদ্ধান্ত। আমি বুঝতে পারি না কেন ইসরাইলে এটা নিয়ে এত হট্টগোল। একটা বাস্তব রাষ্ট্র, যার বাস্তব দায়িত্ব থাকবে- এমন কিছুর সাথে বুঝাপড়া করা, প্যালেস্টাইন অথরিটি’র মতো অস্পষ্ট কিছুর সাথে লেনদেনের চেয়ে ভালো হতে পারে।’
তবে তিনি স্পষ্ট করে দেন, ‘নিশ্চিত কিছু শর্ত অবশ্যই থাকতে হবে; অস্ত্রের নিষেধাজ্ঞা, স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং এমন কাউকে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া যারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সহিংসতার পক্ষে কথা বলে।’ অর্থাৎ তেল আবিবের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযাগ আনার পরও তিনি ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে কথা বলেছেন।
‘দুই রাষ্ট্র সমাধানই একমাত্র উপায়’
সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে গ্রুসম্যান বলেন, ‘আমি এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দুই রাষ্ট্র সমাধানই একমাত্র পথ। এটা জটিল হবে, আমাদের উভয় পক্ষ, ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখাতে হবে, কারণ পথ চলার সময় নানা বাধা আসবে।’
তার ভাষায়, ‘আর কোনো বিকল্প নেই।’
ডেভিড গ্রুসম্যানের এই মন্তব্য গাজায় চলমান সংঘাতের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে এসেছে। একজন ইসরাইলি ইহুদি সাহিত্যিকের কণ্ঠে ‘গণহত্যা’ শব্দটির উচ্চারণ শুধু সাহসী নয়, তা ইসরাইলি সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য এক আত্মসমালোচনার দ্বার খুলে দেয়। ইতিহাসের ভারে নুয়ে পড়া এই অঞ্চলে, এমন সত্য উচ্চারণ হয়তো ভবিষ্যতের জন্য কোনো আলোর রেখা হয়ে উঠতে পারে।