বেলেমের কপ৩০–এর সমাপনীতে ৮০টিরও বেশি দেশের জোরালো দাবির মুখে প্রকাশিত চূড়ান্ত খসড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউটের বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক না করে স্বেচ্ছাস্বরূপ রাখা হয়েছে। কারণ সৌদি আরব ও রাশিয়ার মতো তেল–উৎপাদনকারী শক্তিশালী দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ফেইজ আউটের বিপক্ষে কঠোর ভাষায় আপত্তি জানায়।
১৯৪টি দেশ পারিস চুক্তির অধীনে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ব্রাজিলে একত্রিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণ না করায়, সৌদি আরব ও অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বিপক্ষে কোন জোরালো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি। তবুও, বেলেম ঘোষণা এখন বৈশ্বিক আলোচনার নতুন ভিত্তি তৈরি করেছে।
সম্মেলনে ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজন তহবিল তিনগুণ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এই ১২০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক তহবিল ২০৩৫ সালে প্রদান করা হবে এবং উক্ত তহবিলের কার্যকারিতা ২০২৬ সাল থেকে শুরু হবে। ফলে এটি অনেক দেশকেই তাদের আজকের জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট সহায়তা দিতে পারবে না।
তবে এবারের সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো Just Transition Mechanism গ্রহণ, যা সর্বস্তরের মানুষ, শ্রমিক, নারী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করে সবুজ অর্থনীতিতে স্থানান্তর নিশ্চিত করবে। তবে এই মেকানিজমের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন চূড়ান্ত চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।
এবারের চূড়ান্ত চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পর্কিত কোনো বিষয়বস্তুর সরাসরি উল্লেখ নেই। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের রোডম্যাপকে জাতিসংঘের কার্যক্রমের বাইরে রাখা হয়েছে এবং কলম্বিয়া ও অন্যান্য দেশসমূহের নিজস্ব নেতৃত্বে এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে ব্রাজিল আলাদাভাবে রোডম্যাপ প্রকাশ করতে পারে।
আরও একটি হতাশাজনক বিষয় হল, মূল চুক্তিতে বনসংরক্ষণের রোডম্যাপও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ কপ৩০ আয়োজিত হয়েছিল আমাজনের কোল ঘেঁষে, এবং বনগুলো সর্বদাই বৈশ্বিক জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে ব্রাজিল নতুন “ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ফোরএভার ফ্যাসিলিটি” নামে একটি তহবিল চালু করেছে, যা দেশগুলোকে গাছ সংরক্ষণে অর্থ সহায়তা করবে। যদিও কপ৩০–এ ছোট এবং সীমিত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ়, বাধ্যতামূলক এবং সমন্বিত পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি।
কপ৩০–এর আলোচনায় অস্ট্রেলিয়ার ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কারণ দেশটি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ন্যায়সঙ্গত ও দ্রুত উত্তরণের লক্ষ্যে “বেলেম ঘোষণা” পত্রে স্বাক্ষর করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কীভাবে এ প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে সেটি এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। ঘোষণাপত্রে অস্ট্রেলিয়াসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বলেছে, জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন, অব্যাহত ভর্তুকি ও নতুন লাইসেন্সিং ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমা রক্ষার সঙ্গে “স্পষ্টতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ”। পাশাপাশি অসঙ্গত ভর্তুকি দ্রুত বাতিল করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।
তবে ঘোষণার পরপরই অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ জানান যে, দেশটি নারাব্রি গ্যাস প্রকল্পসহ নতুন কিছু জীবাশ্ম জ্বালানি উদ্যোগ চালিয়ে যেতে চায়, যা সরকারের প্রকৃত অবস্থান ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে দ্বৈততা তৈরি করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জি-২০ বৈঠকে তিনি সরাসরি বলেননি যে, অস্ট্রেলিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন কমাবে কি না, বরং জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির পাশাপাশি গ্যাস, ব্যাটারি ও হাইড্রোর ব্যাকআপ প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেন। তার এই মতামত জলবায়ু আন্দোলনকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
গ্রিনপিস অস্ট্রেলিয়া প্যাসিফিক জানিয়েছে, কপ৩০ সার্বিকভাবে ফসিল ফুয়েল বিষয়ক ঐক্য তৈরি করতে ব্যর্থ হলেও বেলেম ঘোষণা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে—১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য রাখতে হলে নতুন কোনো জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্প হাতে নেয়া না।
অতএব, অস্ট্রেলিয়ার উচিত অবিলম্বে রপ্তানি খাতসহ পুরো জ্বালানি শিল্প থেকে ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা যায় এমন একটি সময়সীমাসহ স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা। একই সময়ে, কপ৩১–এর আলোচনার সভাপতি-মনোনীত হিসেবে ক্রিস বোয়েনের ওপর আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা আরও বেড়েছে। অনেকে বলছেন, অস্ট্রেলিয়া যদি সত্যিই নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে চায়, তবে প্রথমেই নিজেদের দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে এবং পরিবেশগত অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জলবায়ু প্রভাব মূল্যায়নকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
কপ৩০–এ প্রায় ৯০টি দেশ স্বেচ্ছাস্বীকৃত চুক্তিতে সই করেছে, যেন তারা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের রোডম্যাপ তৈরি করতে পারে। তবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। প্রধান অধিবেশন চলাকালীন বিতর্কের কারণে বৈঠক স্থগিত হয়, পরে কপ সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। জাতিসংঘের প্রধান জলবায়ু দূত সাইমন স্টিয়েল বলেছেন, “আমরা ক্লাইমেট যুদ্ধ জিতছি না, তবে আমরা এখনও এতে রয়েছি এবং প্রতিরোধ করছি”।
কপ৩০–এ আদিবাসী অধিকার ও ন্যায্য রূপান্তরের অগ্রগতি স্বীকৃত হলেও, আদিবাসী জনগণকে এখনও হুমকিস্বরূপ দেখার মনোভাব রয়েই গেছে। ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনকে “আদিবাসী কপ” ও “আমাজনিয়ান কপ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, যেখানে প্রায় ২,৫০০ জন আদিবাসী অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৈশ্বিক জলবায়ু পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করায় এবারের ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্কের বার্ষিক “কোলসাল ফসিল” দেওয়া হয়েছে পুরস্কার সৌদি আরব ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। তেল-ভিত্তিক দেশগুলো ও শিল্প লবিস্টদের চাপের কারণে চূড়ান্ত চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ফেজ আউটের বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।
কপ৩০–এর চূড়ান্ত চুক্তিতে তেল ও গ্যাসের বিকল্প বা কার্বন নির্গমন কমানোর দৃঢ় প্রতিশ্রুতির তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো যেমন পালাউর পরিবেশ মন্ত্রী স্টিভেন ভিক্টর উল্লেখ করেছেন, ইতোমধ্যেই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও উত্তাল সমুদ্রের কারণে তাদের জীবন ও জীবিকা ক্ষতির সম্মুখীন। উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোজন তহবিল তিনগুণ বাড়ানোর প্রত্যাশা রাখলেও ১২০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য ৩৬০ বিলিয়নের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
৭০টিরও বেশি দেশ জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) জমা দেয়নি এবং জমা দেওয়া এনডিসিগুলোও পর্যাপ্ত নয়, যা বিশ্বকে ২.৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দিতে পারে। এনডিসিগুলো অপর্যাপ্ত হওয়ায় একটি “অ্যাক্সেলরেটর” প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে, যা আগামী কপ৩১ সম্মেলনে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তরণের রোডম্যাপ নিয়ে প্রায় ৮০টি দেশ আলোচনা শুরু করলেও এটি স্বেচ্ছাস্বীকৃত ও অপ্রতিশ্রুতিমূলক।
জাস্ট ট্রানজিশন প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হলেও নবায়নযোগ্য শক্তি উপাদানের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদ এবং মানবাধিকার বিষয়ক বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে, কপ৩০–এ আশানুরূপ তেমন কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি এবং কপ৩১–এর সভাপতিত্বে অস্ট্রেলিয়ার ওপর এখন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের চাপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ছোট পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়; কার্বন নির্গমন কমাতে বড় এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
পরিশেষে, এবারের কপ৩০ সম্মেলনকে “আশানুরূপ ছোট পদক্ষেপ” বলা যায়। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমারেখা রক্ষার পথে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। উক্ত সম্মেলনে জলবায়ু রক্ষায় নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর দুর্বল প্রতিশ্রুতি এই সম্মেলনের লক্ষ্যকে ব্যর্থ করেছে। এই সম্মেলনের একমাত্র প্রাপ্তি জাস্ট ট্রানজিশনের স্বীকৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প থেকে ক্লিন এনার্জিতে স্থানান্তরিত হওয়া শ্রমিকদেরকে সহায়তা করবে।
লেখক
ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ
অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।



