ইরানের সর্ববৃহৎ সমস্যা পানি : আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে লোকগানের প্রতিধ্বনি

ইরানের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় স্বীকার করছে, আজ দেশের সর্ববৃহৎ সমস্যা পানি। নাগরিকদের সহযোগিতায় খানিকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সংকট কাটাতে প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ।

সৈয়দ মূসা রেজা

বাংলার কৃষিজীবনের সেই বহুল প্রচলিত লোকগান ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই’ যেন ইরানের বর্তমান সংকটের প্রতিধ্বনি। দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় স্বীকার করছে, আজ দেশের সর্ববৃহৎ সমস্যা পানি। নাগরিকদের সহযোগিতায় খানিকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সংকট কাটাতে প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ। পানি আর শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি এখন ইরানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। দেশটির পানি খাতের মুখপাত্র ঈসা বোজোরগজাদে সম্প্রতি হামশাহরি অনলাইনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাঁধের অবস্থা, বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস এবং পানি ব্যবহারের ধরন বদলানো ছাড়া বিকল্প নেই।

রেশনিং নয়, বরং ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ

সামাজিক মাধ্যমে আজ সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন—পানি কি রেশন করে দেয়া হবে? বোজোরগজাদে সাফ জানালেন, ‘না, রেশনিংয়ের প্রশ্নই আসে না। আমরা পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে পুনঃবিন্যাস করছি, বিশেষ করে তেহরান ও কারাজের মতো বড় শহরে। রেশনিং নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সবই গুজব।’

তার মতে, ‘পানি সরবরাহ বাড়াতে নতুন তালেগান–তেহরান প্রকল্প থেকে বছরে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি আসবে। কিন্তু নাগরিকদের সঠিক ব্যবহার না থাকলে এ ব্যবস্থা অকার্যকর। আমরা বলি, পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ চাই, পানি রেশনিং চাই না!’

অপচয়কারীদের জন্য কঠোর বার্তা

তবে কিছু এলাকায় ১২ ঘণ্টার পানি কেটে দেয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে বোজোরগজাদে ব্যাখ্যা দিলেন, ‘যারা মানদণ্ডের দ্বিগুণেরও বেশি পানি ব্যবহার করেন, তারা সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল নন। তাদের জন্যই এই ব্যবস্থা। সাধারণ বেশি ব্যবহারকারীদের পানি কাটা হচ্ছে না।’

তার দৃষ্টিতে এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার। তিনি আরো বলেন, ‘অপচয়কারীরা শুধু অন্য নাগরিকদের সাথেই নয়, গোটা পরিবেশের সাথেও অন্যায় করছে। অথচ ইরানি সংস্কৃতি হলো সহমর্মিতার সংস্কৃতি- মানুষ আসলে একই দেহের অঙ্গ।’

বৃষ্টিপাত, খরা আর কঠিন হিসাব

ইরানে প্রতিবছর প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ঘনমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এর বড় অংশ মাটির নিচে মিশে যায়। আগে নদীতে পৌঁছাত ১৩০ বিলিয়ন ঘনমিটার, এখন তা নেমেছে ১০০–তে, আর খরার বছরে তা হয় মাত্র ৬৫। বার্ষিক ব্যবহার প্রায় ৯২ বিলিয়ন ঘনমিটার, যা বৈশ্বিক মানের দ্বিগুণ। এর ফল ভয়াবহ। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, জলাভূমি বিলীন হচ্ছে, নয়টি সমভূমিতে দেখা দিচ্ছে ভূমিধস।

কৃষির দাপট আর সপ্তম উন্নয়ন পরিকল্পনা

সবচেয়ে বেশি পানি খায় কৃষি খাত- ৮০ শতাংশ। এরপর আসে খাবার পানি ১০ শতাংশ, শিল্প খাত চার শতাংশ। কিন্তু সপ্তম উন্নয়ন পরিকল্পনায় লক্ষ্য কৃষির খরচ ৬৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। এজন্য প্রদেশভিত্তিক টার্গেট নির্ধারণ হয়েছে- কোথায় কত ভূগর্ভস্থ পানি কমাতে হবে, কোথায় বর্জ্যপানি ব্যবহার হবে। ৩১ প্রদেশের জন্য তৈরি হয়েছে পাঁচটি মূল প্রোগ্রাম ও ৪৯টি পদক্ষেপ- পানি সরবরাহ, সংরক্ষণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ব্যবহার সংস্কার ও শাসন কাঠামো উন্নয়ন। উদ্দেশ্য একটাই,পরিবেশগত দিক থেকে টেকসই।

কৃষি থেকে টেবিল পর্যন্ত অপচয়

ইরানে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত পানির প্রায় ৬০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদনশীলতা কম। গ্রিনহাউসেই কেবল ৬০ শতাংশের বেশি দক্ষতা সম্ভব। এর বাইরে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসল মাঠ থেকে টেবিলে পৌঁছানোর আগেই পচে যায়। এ যেন এক নির্মম চিত্র। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা টমেটো, তরমুজ, আপেল- সবই পানির অপচয়ের প্রতীক।

রাজধানী তেহরানের ঝুঁকি

শুষ্ক আবহাওয়ার দেশে সমুদ্রের ধারে ছাড়া বড় মেগাসিটি গড়ে ওঠার অনুমতি নেই। অথচ তেহরান বেড়ে উঠেছে পানির উৎসহীন সমভূমিতে। একের পর এক বাঁধ ও পানি পরিবহন প্রকল্পে শহরকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আজ প্রশ্ন উঠছে, তেহরানের জন্য পানির উৎস প্রমাণ না করে আর নির্মাণের অনুমতি দেয়া উচিত কি? বোজোরগজাদে মনে করেন, প্রতিটি নতুন নির্মাণ প্রকল্পকে প্রমাণ করতে হবে তাদের নিজস্ব পানির উৎস আছে। কোথাও তা সম্ভব গ্রেওয়াটার বা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ব্যবহার করে।

তেহরানে পানির হিসাবের বাইরে চলে যায় প্রায় ৩০ শতাংশ। পুরনো পাইপলাইনে অপচয় ১০ শতাংশেরও বেশি, যেখানে বিশ্বমান আট শতাংশ। শিল্পে তুলনামূলক অবস্থার উন্নতি হলেও কৃষি ও গৃহস্থালিতে অপচয় প্রকট।

ভর্তুকি: সমস্যার শেকড়

কৃষিতে পানি কার্যত বিনামূল্যে। আইনে গম চাষের জন্য কূপ থেকে তোলা প্রতি ঘনমিটার পানির দাম মাত্র ৩০ তুমান, আর কমলার ক্ষেত্রে ৭০ তুমান। এ কারণেই অপচয় থামছে না। বোজোরগজাদে বলেন, ‘ভর্তুকি দিতে হবে আউটপুটে, ইনপুটে নয়। পানিতে ভর্তুকি মানেই অপচয়। প্রকৃত ভর্তুকি হতে হবে কৃষিপণ্যে।’

অসামঞ্জস্যপূর্ণ নির্মাণের দায়

তেহরান বেড়ে উঠেছে মরুভূমির মাঝে, যেখানে পানির উৎস নেই। তাই প্রশ্ন উঠছে, পানি উৎস প্রমাণ ছাড়া আর নির্মাণ নয়। বোজোরগজাদে বলেন, প্রতিটি নির্মাণ প্রকল্পকে প্রমাণ করতে হবে তাদের নিজস্ব পানির উৎস আছে। কোথাও সম্ভব গ্রেওয়াটার ব্যবহার করে, কোথাও সম্ভব ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। তার প্রস্তাব, ‘তেহরানে কৃষি খরচ ৪৫ শতাংশ এবং গৃহস্থালি খরচ ৩০ শতাংশ কমাতে হবে। নতুন ফ্ল্যাট নির্মাণ খরচের এক থেকে দুই শতাংশ আধুনিক পানি নেটওয়ার্কে বিনিয়োগ করা উচিত। এভাবেই বিকল্প সমাধান আসবে।’

বাঁধ, বৃষ্টি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

দেশজুড়ে এ বছর বৃষ্টিপাত গড়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম। বাঁধে পানি জমেছে গত বছরের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম। তেহরানে অবস্থা আরো শোচনীয়- জাতীয় গড়ে বাঁধের পানি ৪০ শতাংশ হলেও রাজধানীতে মাত্র ১৭। তবু আশা আছে। তেহরানের ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ ইতোমধ্যেই ব্যবহার কমিয়েছেন। আরো ১২ শতাংশ মানুষ সহযোগিতা করলে সংকট সামাল দেয়া যাবে। নইলে রাজধানীর ভূগর্ভস্থ জলাধার ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আগামীর পূর্বাভাস

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী শরতেও বৃষ্টির ঘাটতি চলবে। তবু বোজোরগজাদে আশাবাদী, ‘আমরা নাগরিকদের সহযোগিতায় ও ব্যবহার সংস্কারের মাধ্যমে সংকট কাটাব। বেশি বৃষ্টি হলে সেটি হবে জনগণ ও প্রকৃতির বরকত। আমাদের মহান ইরানি সভ্যতা টিকে থাকবে, আগামীর প্রজন্মের হাতে পৌঁছে যাবে।’

শেষকথা

বাংলার কৃষকের গান আজ ইরানের মরুভূমিতে যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে। বাংলাদেশের লোকগানের প্রার্থনা- ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’ আজ ইরানেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পানি যা একসময় ছিল অশেষ দানের প্রতীক, আজ তা হয়ে উঠেছে দুর্লভ সম্পদ। নদী শুকিয়ে যাওয়া, কৃষিক্ষেত্রে অপচয়, শহরের অতিরিক্ত নির্মাণ- সব মিলিয়ে পানি আজ আর শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন।

এখন ইরানের জনগণের হাতেই উত্তর- তারা কি নিজেদের সংস্কৃতি, সভ্যতা আর পরিবেশ রক্ষায় পানির অপচয় রোধ করতে পারবে?