ইসরাইলের আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে আরাগচি বলেছেন, ‘আলোচনায় ফেরার আগে ইরানের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ চাই। শুধু আর্থিক নয়, সবধরনের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলছি। ইরানের বিজ্ঞানী, সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি বদলে গেছে। আগের আলোচনার মতো করে আর কিছুই হবে না।’
সাম্প্রতিক এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাগচি তুলে ধরেছেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ধ্বংসাত্মক হামলার পরবর্তী বাস্তবতা, পরমাণু কর্মসূচির ভবিষ্যৎ, ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুতের রহস্য, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাথে নতুন কৌশলের প্রয়োজনীয়তা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্ভাব্য আলোচনার পথ। এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিনান্সিয়াল টাইমসের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি অ্যান্ড্রু ইংল্যান্ড।
আইএইএর সাথে নতুন মডেল : বাস্তবতা বদলেছে
ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন ব্রিটিশ দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমসের বরাত দিয়ে জানায়, আরাগচি বলেন, ‘ভূমির বাস্তবতা বদলে গেছে। তাই আইএইএ’র সাথে কাজ করার জন্য নতুন একটি পদ্ধতির প্রয়োজন। ওরা সেটা মেনে নিয়েছে এবং এ বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি কারিগরি দল ইরানে পাঠানোর কথা জানিয়েছে।’
এই সহযোগিতা হবে ইরানের সংসদ মজলিসে শুরায় পাস হওয়া আইনের ভিত্তিতে। এর আওতায় পরমাণু সহযোগিতার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের হাতে। ‘এই পরিবর্তনের কারণ একটাই- নিরাপত্তা। আমাদের বিজ্ঞানী, উপকরণ ও পরিকাঠামো সবকিছুই হুমকির মুখে। এমনকি আইএইএর নিজস্ব নিরাপত্তাও এ আলোচনার বিষয়,’ বলেন আরাগচি।
ইউরেনিয়ামের ভাগ্যে কী ঘটেছে?
সাক্ষাৎকারের অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ৪০৮ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব। সাংবাদিক জানতে চান, এই ইউরেনিয়াম কি এখনো রয়েছে?
আরাগচি বলেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। কারণ ইউরেনিয়ামগুলো এমন স্থাপনায় ছিল যেগুলো বোমা হামলায় ধ্বংস হয়েছে। আমি কারিগরি দায়িত্বে নেই, সঠিক হিসাবও আমার কাছে নেই।’
ইসফাহান, নাতাঞ্জ ও ফোরদোর মতো স্থাপনায় আঘাত হানার ফলে কেবল পরিকাঠামো নয়, ইউরেনিয়ামের নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
পরমাণু কর্মসূচির অবস্থা: ধ্বংসের মধ্যেও সক্ষমতা বহাল
আরাগচি স্পষ্ট জানান, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর হামলা ভয়াবহ হলেও প্রযুক্তি ধ্বংস হয়নি। ‘আমাদের কাছে রয়েছে কারিগরি দক্ষতা ও তাত্ত্বিক জ্ঞান। ফোরদো ও নাতাঞ্জে বহু উন্নত সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা এখনো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সক্ষমতা ধরে রেখেছি,’ বলেন তিনি।
নতুন স্থাপনা, যা হামলার আগে চালু হয়নি, সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। ইসফাহানের কাছে নামহীন একটি নতুন স্থাপনা বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জানান আরাগচি।
আলোচনার পথে অন্তরায়: আগ্রাসন ও ‘শূন্য সমৃদ্ধি’ দাবি
আরাগচি জোর দিয়ে বলেন, ইরান আবার আলোচনায় ফিরতে প্রস্তুত, তবে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা সত্যিই সমঝোতায় পৌঁছাতে চায়। ‘যদি ওরা সামরিক ব্যর্থতাকে আলোচনার টেবিলে চাপিয়ে দিতে চায়, তবে সেটা আলোচনার নামান্তর নয়। আমরা কেবল আলোচনায় বসব, যদি বুঝি যে ওরা উইন-উইন সমঝোতা চায়।’
‘শূন্য শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি’- যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবির বিরুদ্ধে আরাগচির জবাব, “এটা বাস্তবসম্মত নয়। আলোচনা চলতে পারে, কিন্তু এই দাবি মেনে কোনো চুক্তি সম্ভব নয়। আমাদের ‘শূন্য পারমাণবিক বোমা’ নীতি আছে, কিন্তু ‘শূন্য সমৃদ্ধি’ নয়।”
হামলার ক্ষতিপূরণ না দিলে আলোচনা নয়
ইসরাইলের আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে আরাগচি বলেন, ‘আলোচনায় ফেরার আগে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ চাই। শুধু আর্থিক নয়, সবধরনের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলছি। আমাদের বিজ্ঞানী, সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি বদলে গেছে। আগের আলোচনার মতো করে আর কিছুই হবে না।’
ইউরোপীয়দের ভূমিকা ও স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম
ইউরোপের তিন দেশ আলোচনায় ফিরতে চাইলেও আরাগচির মতে, তাদের নৈতিক কিংবা আইনগতভাবে ‘স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম’ সক্রিয় করার অধিকার নেই। স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম হলো জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুযায়ী গৃহীত এক কূটনৈতিক ও আইনগত ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য- যদি ইরান চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে আগে যেসব আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল হয়ে যাবে।
‘যেহেতু ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি এবং শূন্য সমৃদ্ধি সমর্থন করেছে, ইউরোপ ও আমেরিকা আর জেসিপিওএ বা ইরান পারমাণবিক চুক্তির পক্ষ নয়। ফলে তারা বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকারও হারিয়েছে।’ পাশাপাশি তিনি বলেন, ’তারা যদি এই মেকানিজম চালু করে, তবে আমরা তাদের সাথে আর কোনো পারমাণবিক আলোচনা করব না।’
পারমাণবিক অস্ত্র নয়, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির নীতি
আরাগচি আবারো বলেন, ‘পরমাণু অস্ত্র আমাদের নীতির বিরুদ্ধে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তা অমানবিক ও হারাম। আমাদের ফাতাওয়া রয়েছে এই বিষয়ে। আমরা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে বিশ্বাস করি।’
ওমানে আলোচনা, চীনে তেল রফতানি এবং যুদ্ধের ভবিষ্যৎ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফের সাথে বার্তা বিনিময় হয়েছে উল্লেখ করে আরাগচি বলেন, আলোচনা এখন থেমে আছে। ওমানে আলোচনা নিয়ে কিছু প্রস্তাব এসেছে, তবে বাস্তবতা বদলানো ছাড়া তা সম্ভব নয়।
চীনে তেল রফতানির বিষয়েও কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তেল রফতানি করি, এবং আমরা এটা চালিয়ে যাব। নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে বাঁচতে ইরান পারদর্শী।’
সাক্ষাৎকারের শেষদিকে সাংবাদিক জানতে চান, ‘এই যুদ্ধ কি শেষ, নাকি প্রথম ধাপ মাত্র?’
আরাগচি বলেন, ‘আগ্রাসন থেমেছে, আমরাও আত্মরক্ষা থামিয়েছি। কিন্তু কোনো অস্ত্রবিরতি হয়নি। যেকোনো সময় যুদ্ধ আবার শুরু হতে পারে। শুধু ইরান নয়, সবারই শঙ্কিত হওয়া উচিত।’
এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট হয়েছে- ইরান এখন আর ২০১৫ সালের মতো আলোচনার অবস্থানে নেই। যুদ্ধের ক্ষত, প্রযুক্তির দৃঢ়তা, এবং জাতীয় সম্মান নিয়ে যে অবস্থান তারা নিয়েছে, তা শুধু ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দাবি করে। শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইলেও, ইরান স্পষ্ট করে দিয়েছে, এবার কোনো পক্ষ আগের মতো সুবিধা নিয়ে আলোচনার টেবিলে আসতে পারবে না।