দ্বিধার জট : ইরানে নারীর মোটরসাইকেল চালানোর বৈধতা নিয়ে টানাপোড়েন

ইরানে প্রায় এক দশক ধরে নারীদের মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্সকে বৈধ করার চেষ্টা চলছে। সময়ের সাথে সাথে নারীদের লাইসেন্স প্রাপ্তির দাবি গণমাধ্যমে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।

সৈয়দ মূসা রেজা

শহরের ব্যস্ত রাস্তায় মোটরসাইকেল ছুটে যাচ্ছে। হেলমেট পরা মেয়ে, পেছনে ঝুলছে স্কুলব্যাগ। বয়সে কিশোরী, তবু ট্রাফিকের ভিড়ে অনায়াসে চলাফেরা করছে। অথচ সে জানে না, তার হাতে থাকা হ্যান্ডেল কেবল গতির প্রতীক নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার দিকেও ইঙ্গিত করছে। কারণ ইরানে নারীদের জন্য মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স এখনো আইনগত ধাঁধার মধ্যে আটকে আছে।

তাসনিম নিউজের এক সামাজিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় এক দশক ধরে নারীদের মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্সকে বৈধ করার চেষ্টা চলছে। এর আগেও কিছু নারী ক্রীড়াবিদ মোটরসাইকেল ট্র্যাকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন, কিন্তু শহরের রাস্তায় তা চালানো হতো না। সময়ের সাথে সাথে নারীদের লাইসেন্স প্রাপ্তির দাবি গণমাধ্যমে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। সমর্থক-বিরোধীদের তর্কে মেতেছে নাগরিক সমাজ থেকে আইনজীবী, মন্ত্রী, সংসদ, সরকার এমনকি পুলিশ ও বিচার বিভাগও। প্রত্যেকে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে আইনি যুক্তি ও সামাজিক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন।

কিন্তু সব বিতর্কের পরও পুলিশ এখনো বলছে, বিদ্যমান আইন নারীদের লাইসেন্স প্রদানের অনুমতি দেয় না। সম্প্রতি ফারাজ ট্রাফিক পুলিশের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৈমুর হোসেইনি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, সরকার বর্তমানে এমন একটি প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে, যেখানে নারীদের ‘মোটরসাইকেলের পেছনে যাত্রী’ হিসেবে চলাচল করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। আর পুলিশ অপেক্ষা করছে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য।

হোসেইনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘আমরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। আইন যেভাবে নির্দেশ দেবে, আমরা কেবল তা-ই বাস্তবায়ন করব। নিজস্ব ব্যাখ্যা বা ফতোয়া দেয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই।’

এই অনিশ্চয়তা এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একদিকে নারীদের লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই, অন্যদিকে রাস্তায় নারী চালকদের দেখলেও পুলিশ কার্যত তা উপেক্ষা করছে। এই অঘোষিত উদাসীনতাই নতুন বিপদের জন্ম দিয়েছে- অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীরা পর্যন্ত সাহস করে মোটরসাইকেল চালাতে শুরু করেছে।

আইন অনুযায়ী, যেকোনো যানবাহন চালাতে হলে লাইসেন্স লাগবে। ৫০ সিসি মোটরসাইকেল (সর্বোচ্চ চার কিলোওয়াট ক্ষমতা) কিংবা ১২৫ সিসি মোটরসাইকেল (দুই বা তিন চাকা, সর্বোচ্চ ১১ কিলোওয়াট ক্ষমতা) চালাতে ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর। তবে শর্ত হচ্ছে প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করে লাইসেন্স পাওয়া, যা বর্তমানে কেবল পুরুষদের জন্য উন্মুক্ত।

অতএব, কিশোরীরা যখন লাইসেন্স ছাড়া রাস্তায় নামছে, তখন তারা শুধু নিজেরাই বিপদের মধ্যে পড়ছে না, বরং অন্যান্য নাগরিকদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করছে। বেপরোয়া চালনা, অভিজ্ঞতার অভাব, বয়সজনিত আবেগপ্রবণতা- সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফল হতে পারে আজীবন পঙ্গুত্ব, প্রাণহানি কিংবা আইনি জটিলতা।

তাসনিম নিউজ-এর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এই সমস্যার প্রভাব কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও। আইন প্রয়োগে উদাসীনতা একধরনের নীরব অনুমোদন হিসেবে কাজ করছে। সমাজে একবার যদি ধারণা জন্ম নেয় যে নিয়ম ভাঙা চলতি পথ, তবে সেই প্রবণতা অন্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়তে দেরি হবে না।

আইন ও নীতিনির্ধারকেরা যেন একপ্রকার দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ এই দীর্ঘসূত্রিতার অবসান জরুরি। নাগরিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার, ইসলামী পরামর্শ সভা (সংসদ) এবং পুলিশকে দ্রুত ও সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- নারীরা মোটরসাইকেল চালাতে পারবেন কি-না। তবেই পরিষ্কার হবে, কার কী দায়িত্ব।

একইসাথে পুলিশকেও কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, বরং প্রতিরোধমূলক ও শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে পরিবার ও কিশোর–কিশোরীদের বোঝাতে হবে, লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো কেবল আইন ভঙ্গ নয়, জীবনঘাতীও বটে। নারী চালকদের লাইসেন্স ইস্যু করা হবে কি-না, এই প্রশ্নের জট খুলতে যত দেরি হবে, ততই বেড়ে যাবে অনিশ্চয়তা, ঝুঁকি আর সামাজিক বিপর্যয়। সময় এসেছে অচলাবস্থার ইতি টেনে নারীদের মোটরসাইকেল চালনার প্রশ্নে রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট অবস্থান জানানোর।