ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন জানিয়েছে, নিজেদের পণবন্দী সন্তানদের কাছাকাছি পৌঁছাতে এবার সাগরপথে গাজার উপকূলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিছু ইসরাইলি পরিবারের সদস্যরা। ইসরাইলি পণবন্দীদের পরিবারগুলোর এই সিদ্ধান্ত প্রথমে প্রকাশ করেছে হিব্রু দৈনিক ইসাইয়ল হায়োম ও চ্যানেল-১২।
তারা জানায়, ইউরোপ থেকে গাজার সমর্থনে যেসব জাহাজ আসছে, তার প্রতিক্রিয়ায় এই পরিবারগুলোও এবার সমুদ্রপথে গাজার দিকে পাড়ি জমাতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্য, একদিকে যেন সন্তানদের যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকা যায়, আর অন্যদিকে যেন আন্তর্জাতিক জনমতকে নিজেদের দিকে আকর্ষণ করা যায়।
চ্যানেল ১২-এর সোমবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার পণবন্দীদের কয়েকটি পরিবার নিজেদের সন্তানদের মুক্তির দাবিতে নৌকায় করে গাজারি দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কারণ, বন্দীবিনিময় চুক্তি নিয়ে আলোচনায় যে অচলাবস্থা চলছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটানো দরকার। পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘আমরা আমাদের প্রিয়জনদের কাছে থাকতে চাই।’ তাদের এই পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে, নীরবতা ভেঙে মানবিক এই ইস্যুতে একটা শক্ত অবস্থান নেয়া এবং এর সমাধান চাওয়া।
তবে এ রকম উদ্যোগকে মোটেই স্বাগত জানাতে নারাজ ডানপন্থী লিকুদ পার্টির নেসেট সদস্য তালি গটলিব। কমিটি চেয়ারের দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে সংসদীয় বিতর্কে তিনি পণবন্দী সেনাদের পরিবারের উদ্দেশে বলেন, ‘যদি হামাস আপনাদের এই বক্তব্য শুনে, তাহলে তারা কখনোই তাদের হাতে আটক ওই সেনাদের ফিরিয়ে দেবে না।’
এক পরিবারের প্রতিনিধি তখন জিজ্ঞেস করেন, ‘আমাদের তাহলে চুপ করে থাকতে হবে?’ গটলিব জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, চুপ থাকুন।’ প্রতিনিধি ফের জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি বন্দী সেনাদের পরিবারের লোকদের বলছেন চুপ করে থাকতে?’ গটলিবের জবাব, ‘হ্যাঁ, চুপ করেই থাকুন।’
এদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার সাবেক প্রধান ইয়োসি কুপারওয়াসার বলেন, ‘ইসরাইল কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়েই চিন্তিত।’ তার মতে, সমস্যা গাজা দখল নয়, বরং গাজা দখলের দীর্ঘমেয়াদি খরচ।
লরেন ওয়েহবের সঞ্চালিত দিস ইভনিং অনুষ্ঠানে কুপারওয়াসার আরো বলেন, ‘ট্রাম্প ইসরাইলের অবস্থান খুব ভালোভাবে বোঝেন। তিনি চান অপহৃত সেনাদের মুক্তি। আমরা যা যা করা দরকার, করব। তবে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব না হয়, তাহলে আমাদের আরেকটি পথ বেছে নিতে হবে। মার্কিনীরা যতদিন না বুঝছে যে হামাসের সাথে কোনো চুক্তির সুযোগ নেই, ততদিন আমরা হামাসকে পরাস্ত করেই সমাধান খুঁজব। ইসরাইলি বাহিনী গাজা দখলে রাখতে সক্ষম। আমাদের সেখানে যথেষ্ট সেনা মোতায়েন আছে। কিন্তু সমস্যাটা দখলের দীর্ঘমেয়াদি খরচ।’
তবে এই অবস্থান থেকে সতর্ক করে দিয়েছেন ইসরাইলি সেনাপ্রধান আইয়াল জামির। তিনি বলেন, ‘গাজায় বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানো হলে ইসরাইলি বন্দীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’
চ্যানেল ১৩-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় অচলাবস্থার পরই ইসরাইল নতুন করে সামরিক অভিযান চালাতে চাইছে। তার মধ্যেই গাজার ভেতর থেকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা নতুন পণবন্দীদের ভিডিও প্রকাশ করেছে, যা সেনাবাহিনী ও পরিবারের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে। জানা যায়, জামির ব্যক্তিগতভাবে তার ঘনিষ্ঠদের বলেন, ‘আমি এমন কোনো অভিযানে অনুমতি দেব না, যা বন্দীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবে।’
এ পরিস্থিতিতে বারবার হামাস ঘোষণা দিয়েছে, তারা সব পণবন্দীকে একসাথে মুক্তি দিতে প্রস্তুত, যদি ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ করে, গাজা থেকে সেনা সরিয়ে নেয় এবং ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেয়। কিন্তু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই চুক্তি এড়িয়ে চলছেন। তিনি নতুন শর্ত সামনে আনছেন। যার মধ্যে আছে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর অস্ত্রত্যাগের দাবি। সর্বশেষ, এই কারণেই দোহায় হামাসের সাথে চলা পরোক্ষ আলোচনাতেও ইসরাইলি প্রশাসন নিজেদের অংশগ্রহণ বাতিল করেছে।
সন্তানদের কাছে পৌঁছানোর জন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার দিকে সাগর পাড়ি দিতে চাইছেন পণবন্দী পরিবারের সদস্যরা। এর ভেতর রয়েছে একদিকে ভালবাসার আকুতি, অন্যদিকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের নিষ্ঠুর নিষ্ক্রিয়তায় জন্ম নেয়া বিক্ষোভ। এই ছোট্ট সমুদ্রযাত্রা হয়তো দীর্ঘ দিনের যুদ্ধ, রাজনীতি আর মানবিক সঙ্কটের এক নতুন মোড় নিতে চলেছে।