সৌন্দর্যের লীলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর

স্থানীয়দের কাছে ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি’ নামে পরিচিত এই প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি অমূল্য রত্ন।

নাজমুস শাহাদাত

Location :

Tahirpur
টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওর |সংগৃহীত

টাঙ্গুয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ জেলার এক অপূর্ব প্রাকৃতিক রত্ন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হিসেবে পরিচিত। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এই হাওরটি বর্ষাকালে বিস্তৃত হয় প্রায় ২০ হাজার একর পর্যন্ত, যেন এক বিশাল জলরাশি। এখানকার অক্সিজেন সমৃদ্ধ পানি, সুবিস্তৃত জলাবন, নীল আকাশ এবং পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য এই হাওরকে এক অদ্বিতীয় সৌন্দর্যে সাজিয়ে তুলেছে। স্থানীয়দের কাছে ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি’ নামে পরিচিত এই প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি অমূল্য রত্ন।

ইতিহাস

টাঙ্গুয়ার হাওরের আশেপাশে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের বসবাস ছিল। ওই সময়ে এই অঞ্চলে হিন্দু, গারো, হাজং, খাসি ও কোচ জাতির মানুষ বসবাস করতেন। তারা কৃষি ও মাছ ধরার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই অঞ্চলের উর্বর মাটি ও প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের আকর্ষণ করেছিল। ঔপনিবেশিক যুগে, সুনামগঞ্জ অঞ্চলের জমিদাররা টাঙ্গুয়ার হাওরে বড় পাঁসি নৌকায় চড়ে পাখি শিকার করতেন। এই শিকার ছিল তাদের বিলাসিতা ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। তবে, এই শিকার প্রথা হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। ২০ শতকের শেষের দিকে, টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশগত অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। অতিরিক্ত মাছ ধরা, বন উজাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়। এই পরিস্থিতিতে, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ (ECA) হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর, ২০০০ সালে এটি ‘রামসার সাইট’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।

Tanguar Haor-02

টাঙ্গুয়ার হাওরে কখন যাবেন

বর্ষাকাল টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাওর ভ্রমণ করা ভালো। বছরের অন্য সময় সাধারণত পানি অনেক কম থাকে। তবে ভিন্ন এক পরিবেশের টাঙ্গুয়ার হাওর এবং সেই সঙ্গে অতিথি পাখি দেখতে চাইলে শীতকালেই যেতে হবে আপনাকে।

হাওর ভ্রমণে কী কী দেখবেন

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ শুধু হাওর দেখা নয়, সঙ্গে আরও কিছু স্পট সাধারণত সবাই ঘুরে দেখে থাকে। টাঙ্গুয়ার হাওরে গেলে ছোট ছোট সোয়াম্প ফরেস্ট, ওয়াচ টাওয়ার, শহীদ সিরাজ লেক (নীলাদ্রি লেক), শিমুল বাগান, বারিক টিলা, যাদুকাটা নদী, লাউড়ের গড়সহ আরও বেশকিছু স্পট ঘুরে দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য বেশ বৈচিত্র্যময়। হাওরটি নানা প্রজাতির পাখি, বিশেষত অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে সাদা বক, কালো বক এবং বিভিন্ন প্রজাতির ডকের কলতান, যা পাখি পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী যেকোনো মানুষকে আকর্ষণ করে।

ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে যাত্রা শুরু করতে হলে প্রথমে সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছানো প্রয়োজন। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যেতে বাস বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছানোর পর আপনাকে সিএনজি বা লেগুনা ভাড়া করে তাহিরপুর যেতে হবে, তারপর সেখানে থেকে নৌকায় হাওরের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে।

Tanguar Haor-03

যাত্রা শুরু করার পর প্রথমে সুনামগঞ্জ শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। এরপর, তাহিরপুরের দিকে যেতে যেতে পাহাড়ি এলাকা এবং মেঘালয় পর্বতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে পাবেন। তবে, এই পথে কিছুটা খারাপ রাস্তাও রয়েছে, যা ভ্রমণের সময় কিছুটা অস্বস্তির সৃষ্টি করতে পারে। তবে, এই পথের সৌন্দর্য এই অস্বস্তি ভুলিয়ে দেয়।

একবার হাওরে পৌঁছানোর পর নৌকায় চড়ে আপনি বিশাল জলরাশির মধ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করবেন। নৌকার ভেতর থেকে চারপাশে তাকালে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়, হাওরের জলাভূমি, জলাবন, এবং শাপলা ফুলের বিস্তীর্ণ ক্ষেত দেখতে পাবেন। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, মাছ, এবং শাপলার মাঝখানে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি হয়।

আবাসন

টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ এক কথায় শুদ্ধ। আপনি যখন এখানে থাকবেন, তখন সবুজ প্রকৃতির মাঝে, পাখির ডাক শুনতে শুনতে পুরো রাত পার হবে। তবে, একসময় হাওরে থাকার পরিবেশ ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। তবে বর্তমানে উন্নত হাউজবোট এবং গেস্টহাউসের ব্যবস্থা রয়েছে। এসব হাউজবোটে থাকতে গিয়ে আপনি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যেমন বাথরুম, চার্জিং সুবিধা, খাদ্য এবং পানীয় পাবেন। তবে, কিছুটা দামের পার্থক্য দেখা যায় এবং বাসস্থানের কিছু সীমাবদ্ধতা যেমন প্রবাহিত পানির ব্যবস্থার অভাব বা খাবারের মানের কিছু সমস্যা থাকতে পারে।

Tanguar Haor-04

পর্যটন ও পরিবেশ দূষণ

একদিকে টাঙ্গুয়ার হাওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, অন্যদিকে এটি বর্তমানে নানা পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যেমন, হাওরে প্রতিনিয়ত প্লাস্টিকের বোতল, চিপস, ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের চায়ের কাপ, নানান রকমের খাবারের প্যাকেটসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এসব প্লাস্টিকের বর্জ্য হাওরের পানিতে ভাসতে দেখা যায় নিয়মিত। এছাড়া, হাউসবোট থেকে রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট, খাবারের অবশিষ্টাংশ, পচা শাক-সবজির খোসা- এই জৈব বর্জ্যগুলো সরাসরি হাওরের পানিতে ফেলা হচ্ছে। এর চেয়েও তীব্র সমস্যা হলো, হাউসবোটগুলোতে সেফটি ট্যাংক না থাকায় প্রতিদিন শত-শত পর্যটকদের মল-মূত্র এবং পয়ঃনিষ্কাশনের পানি মিশে যাচ্ছে হাওরের স্বচ্ছ পানির সঙ্গে। এই বর্জ্যগুলো পানিকে নিয়মিত দূষিত করছে। যার কারণে দিনদিন জলজ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একইভাবে, ইঞ্জিন থেকে নিঃসৃত তেল/ডিজেলসহ অন্যান্য তৈলাক্ত বর্জ্য হাওরের পানিতে পরে পানির উপরে একটি বিষাক্ত স্তর তৈরি করছে। এই স্তর সূর্যের আলো এবং অক্সিজেনকে পানিতে প্রবেশ করতে বাধা দেয়, যার ফলে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীরা তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করতে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।

বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

টাঙ্গুয়ার হাওর, যা বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার একটি অমূল্য প্রাকৃতিক রত্ন হিসেবে পরিচিত, বর্তমানে বিভিন্ন বাস্তবতা এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই জলাভূমি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি স্থানীয় জনগণের নির্ভরশীলতা এবং পর্যটকদের আগমনে এটি একদিকে যেমন আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে কিছু চ্যালেঞ্জও সামনে আসছে। পরিবেশগত পরিবর্তন, মানুষের প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সুবিধার মাঝে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার ব্যবস্থা ছিল সীমিত ও অস্বাস্থ্যকর। তবে বর্তমানে আধুনিক হাউজবোটের ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম, চার্জিং সুবিধা ও আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

টাঙ্গুয়ার হাওর তার জীববৈচিত্র্য, অতিথি পাখির অভয়ারণ্য এবং মিঠাপানির জলাভূমি নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তবে, এখানে পরিবেশগত সংকটও দেখা দিয়েছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত মাছ ধরা, বনভূমি উজাড়, এবং জলাশয়ে প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলার মতো মানবসৃষ্ট কার্যক্রম এর অন্যতম কারণ।

পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর উপর পরিবেশগত চাপও বাড়ছে। পর্যটকদের দ্বারা জলাভূমিতে বর্জ্য ফেলা, পর্যটন সংক্রান্ত অবকাঠামোর গড়বড়, এবং নৌকা চলাচলের কারণে জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে অত্যধিক পর্যটন এর জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা পাখিদের অভ্যন্তরীণ বাসস্থানকে বিপন্ন করছে।

Tanguar Haor-05

সর্বোপরি, টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের এক অমূল্য প্রাকৃতিক রত্ন, যা তার অপূর্ব সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য এবং মনোমুগ্ধকর পরিবেশের জন্য পরিচিত। এটি শুধু একটি জলাভূমি নয়, বরং স্থানীয় জনগণের জীবিকা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক অনবদ্য অংশ। এই হাওর, যেখানে শাপলার বাগান, অতিথি পাখির কলতান, এবং মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়ের দৃশ্য একে একটি আধ্যাত্মিক স্থানে পরিণত করেছে, সেখানে ভ্রমণকারীরা শান্তি, প্রশান্তি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পূর্ণ অভিজ্ঞতা পান।

তবে, টাঙ্গুয়ার হাওরের বর্তমান অবস্থাও কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে। অতিরিক্ত পর্যটন, অবৈধ মাছ ধরা, বন উজাড়, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, এই হাওরের স্থায়ীত্ব এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে হলে আমাদের সবাইকে, সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং পর্যটকদের একত্রে কাজ করতে হবে। পরিবেশের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি, টেকসই পর্যটনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে, টাঙ্গুয়ার হাওর তার প্রকৃত সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা সম্ভব। এটি একদিকে যেমন আমাদের দেশের এক মহামূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ, তেমনি বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণের এক উদাহরণ হতে পারে।