বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর্যটনের প্রবেশদ্বার মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা। চায়ের রাজধানীখ্যাত এই এলাকাটি এখন দেশী-বিদেশী ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। সবুজ চা-বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর শ্রীমঙ্গলের পর্যটন শিল্প আজ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই শিল্পের কারণে সবচেয়ে বেশি বদলে গেছে শ্রীমঙ্গলের রাধানগর নামের গ্রামসহ আশপাশের এলাকা।
গ্রামটিকে এখন টুরিস্ট ভিলেজ বা পর্যটনের গ্রাম বলে থাকেন সবাই। উপজেলার সদর ইউনিয়নের এই গ্রামটি শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় উদ্যোক্তারা বেছে নিয়েছেন। সেই সাথে সারা দিয়েছেন পর্যটকরাও।
জানা যায়, শ্রীমঙ্গলের পাঁচ তারকা মানের হোটেল ‘গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ’কে অনুসরণ করে এর ৪-৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখন অর্ধশতাধিক ছোট-বড় হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠছে। সেই সাথে গড়ে উঠেছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানান ব্যবসা। এসব প্রতিষ্ঠানের নান্দনিকতা এবং আধুনিকতার মেলবন্দনের সাথে পর্যটন স্পর্শে বদলে যাওয়া গ্রামেই কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক’শ যুবকের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার খুব কাছাকাছি হওয়ায় সারা বছরজুড়েই এই গ্রামে প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমনপিপাসুরা অবস্থান করে থাকেন। তারা স্বপরিবারে কিংবা বন্ধু-বান্ধব মিলে ছুঠে আসেন নিরাপদ রাত্রীযাপনের জন্য। এতে এখন রাধানগর আর নিছক একটি গ্রাম নয়, এটি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সফলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যটনের বিকাশ কিভাবে একটি গ্রামকে বদলে দিতে পারে, রাধানগর তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
স্থানীয়রা আরো জানান, শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাধানগর একসময় ছিল নিস্তব্ধ, কৃষিনির্ভর একটি গ্রাম। স্বাধীনতার পর আখচাষের জন্য বিখ্যাত এ গ্রামটি পরবর্তিতে লেবু ও কাঁঠালের বাগান করা এই অঞ্চলের মানুষকে জীবিকার পথ দেখায়। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে পর্যটনের সম্ভাবনা বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে বদলে যায় গ্রামের চিত্র। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়া বনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর বিদেশী পর্যটকরা আসতে থাকেন বন ভ্রমণে। প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের রাত্রীযাপনের জন্য ‘নিসর্গ ইকো কটেজ’ নামে প্রথম কটেজ তৈরি হয়। পরবর্তীতে লাউয়াছড়া আর চা-বাগান সন্নিকটে থাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে তৈরি হয় এ অঞ্চলের প্রথম পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট। সেই রিসোর্টকে অনুসরণ করেই রাধানগরে বেশ কিছু উদ্যোক্তা তৈরি হয়। পর্যটকদের সারা পাওয়ায় নতুন আত্মপরিচয় খুঁজে পায় এ গ্রামটি।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে রাধানগরে গড়ে উঠেছে ৫০টির বেশি রিসোর্ট, কটেজ ও গেস্টহাউস। বর্তমানে পুরো শ্রীমঙ্গলে প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার পর্যটক থাকার সুবিধা থাকলেও শুধু রাধানগর গ্রামেই রাতযাপন করতে পারেন হাজার দেড়ের পর্যটক। শুধু দেশী নয়, বিদেশী পর্যটকরাও প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন।
গ্রামের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে হোটেল প্যারাগন, নভেম ইকো রিসোর্ট, বালিশিরা রিসোর্ট, মাধবীলতা ইকো কটেজ, অরণ্যের দিনরাত্রি, শান্তিবাড়ি ইকো রিসোর্ট, লিচিবাড়ি ইকো রিসোর্ট, নিসর্গ নিরব ইকো কটেজ, চামুং রেস্টুরেন্ট, ওয়ান্ডার হিল ইকো রিসোর্ট, হার্মিটেম রিসোর্ট, ভ্রমণ কুঠী, পত্রস্নান ইকো রিসোর্ট, জলধারা রিসোর্ট, বৃষ্টি বিলাস রিসোর্ট। এসব রিসোর্টগুলোর স্থাপত্যশৈলীও নজরকাড়া। বেশ কিছু কটেজ রয়েছে বাঁশ-কাঠের উপকরণের ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। ফলে রাধানগর হয়ে উঠেছে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের রোল মডেল।
স্থানীয়রা জানায়, গ্রামে রিসোর্ট হওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রায় ৪-৫ শ’ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। কেউ রিসোর্ট পরিচালনা করছেন, কেউ রেস্তোরাঁ চালাচ্ছেন, কেউ পর্যটক পরিবহনের কাজে নিয়োজিত। হস্তশিল্প বিক্রি, চা পাতা ও মনিপুরি কাপড় দোকান, গাইড ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসার সাথে জড়িয়ে বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।
শ্রীমঙ্গল রাধানগরের চামুং রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ইকো ক্যাফের পরিচালক তাপস দাশ বলেন, ‘প্রতিদিন শত শত পর্যটক আমাদের প্রতিষ্টানসহ গ্রামে বেড়াতে আসেন। বিশেষ করে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার পর্যটকরে আগমনে মুখরিত থাকে গ্রামটি। এতে স্থানীয়দের আয় বাড়ছে, সরকারও পাচ্ছে বিপুল রাজস্ব।’
শান্তিবাড়ি ইকো রিসোর্টের পরিচালক তানভীর লিংকন আহমেদ জানান, ‘২০১২ সালে আমরা পরিবেশবান্ধব ইকো রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা করি। এখন অসংখ্য হোটেল-রিসোর্ট হয়েছে। দেশী-বিদেশী পর্যটকরা প্রকৃতির মধ্যে থাকতে বেশ স্বাচ্ছন্দ বোধ করছেন। এতে একদিকে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের প্রসার ঘটছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।’
রাধানগরের পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্যসচিব তারেকুর রহমান পাপ্পু বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল দেশের পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় একটা জায়গা। ইতোমধ্যে রাধানগরে কমিউনিটি বেসড ট্যুরিজম গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। রাস্তা-ঘাটের উন্নয়নসহ সরকারের আরো উদ্যোগ এ এলাকায় বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘পর্যটন শিল্পে শ্রীমঙ্গলের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে রাধানগরে রাত্রীকালীন সড়ক বাতি স্থাপন করেছি। পর্যটন উন্নয়নে আরো কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প বিকাশে কাজ চলছে।’



