কৃত্রিম অক্সিজেনহীন মানাসলু জয় বাবরের, ট্যাবু ভাঙলেন তানভীর

বাংলাদেশি পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী অক্সিজেন ছাড়াই মানাসলু জয় করে ইতিহাস গড়েছেন, আর প্রথম অভিযানে তানভীর আহমেদ ভেঙেছেন মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের ট্যাবু।

আহমেদ ফয়সাল
ডা. বাবর আলী ও তানভীর আহমেদ
ডা. বাবর আলী ও তানভীর আহমেদ |সংগৃহীত

নেপালের মানাসলু পর্বতশৃঙ্গে লাল-সবুজের পতাকা উড়ালেন বাংলাদেশের দুই পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী ও তানভীর আহমেদ।

বৃহস্পতিবার ভোরে তারা সফলভাবে পৌঁছে যান পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম শৃঙ্গ মানাসলুর (৮১৬৩ মিটার) চূড়ায়।

এর মাধ্যমে ইতিহাস গড়লেন দেশের অন্যতম শীর্ষ পর্বতারোহী এভারেস্টজয়ী ডা. বাবর আলী। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী, যিনি আট হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত জয় করলেন কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই। অন্যদিকে, তানভীর আহমেদ তার প্রথম আটহাজারি অভিযানে চূড়ায় পৌঁছে ভাঙলেন আরেকটি ট্যাবু- প্রাতিষ্ঠানিক মাউন্টেনিয়ারিং শিক্ষা ছাড়াই এই উচ্চতায় জয় সম্ভব।

গণমাধ্যমকে খবরটি নিশ্চিত করেছেন এই অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান। এই অভিযানের আউটফিটার স্নোয়ি হরাইজন ট্রেক্স অ্যান্ড এক্সপিডিশনের সত্ত্বাধিকারী বোধা রাজ ভান্ডারির সূত্রে এই তথ্য জানান তিনি।

বেসক্যাম্প সূত্রের বরাত দিয়ে ফরহান জামান জানান, বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে পৃথিবীর অষ্টম শীর্ষ পর্বত মানাসলুতে এই কীর্তি গড়েছে বাবর। আর রাত ৩টা ৪০ মিনিটে মানাসলুর শীর্ষে লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন তানভীর আহমেদ।

‘মানাসলু অ্যাসেন্ট: ভার্টিক্যাল ডুয়ো’ শীর্ষক এই অভিযানের আয়োজক পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। ক্লাবটির সভাপতি ও অভিযান ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, ‘বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ পর্বত মানাসলুতে একই দিনে দু’বার উড়ল আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত বাবরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া আটহাজারি শিখর আরোহণের। উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার পর আমরা চূড়ান্তভাবে ঠিক করি যে এই মানাসলুই হবে কাঙ্ক্ষিত সেই চেষ্টার পর্বত। আজ প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বাবর আলী কৃত্রিম অক্সিজেন সহায়তা ছাড়াই আরোহণ করেছে এই আটহাজারি শৃঙ্গ।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের অপর পর্বতারোহী তানভীরের এটি প্রথম আটহাজারি অভিযান। ইতোপূর্বে আটহাজারি শিখরে সফল সব বাংলাদেশী পর্বতারোহীই পর্বতারোহণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাপ্ত। এ থেকে অনেকের ধারণা ছিল, অতি-উচ্চ পর্বতে সফলতা পেতে বিদেশে গিয়ে মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের বিকল্প নেই। এই ধরনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তানভীরের নেই। ওর সম্বল দেশে সীমিত সুবিধার মধ্যে অনুশীলন আর ইচ্ছাশক্তি। তাই মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স-সংক্রান্ত ওই ট্যাবু আমরা তাকে দিয়ে ভাঙতে চেয়েছি। দুজনের কঠোর পরিশ্রমের ওপর আমরা আস্থা রেখেছি এবং দুজনেই আজ সফল হয়েছে। একজন করেছে অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া সামিট এবং অপরজন দেশে শিখেই হয়েছে সফল।’

তানভীর ও বাবর বাংলাদেশ থেকে নেপালে গিয়েছেন গত ৫ সেপ্টেম্বর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৭ সেপ্টেম্বর তারা কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে যান তিলচে গ্রামে। এরপর পাঁচ দিন হেঁটে তারা পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। সেখানে দু’দিন বিশ্রাম নিয়ে তারা শুরু করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া। প্রথম দফা ক্যাম্প-১ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে তারা নেমে আসেন। এক দিন বিশ্রামের পর দ্বিতীয় দফা আরোহণে তানভীর ক্যাম্প-২ (৬৩০০ মিটার) এবং বাবর ক্যাম্প-৩ (৬৭০০ মিটার) এ রাত কাটিয়ে শেষ করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার পর্ব।

এক দিন বেসক্যাম্পে বিশ্রামের পর আসে চূড়ান্ত চেষ্টার ক্ষণ। তানভীর ২২ সেপ্টেম্বর বেসক্যাম্প থেকে যাত্রারম্ভ করে উঠে আসেন ক্যাম্প-১ এবং পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২। এদিকে বাবর এক দিন পর রওনা দিয়ে সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ। ২৪ সেপ্টেম্বর দু’জনেই ক্যাম্প-৩ তে রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ পৌঁছে যান ক্যাম্প-৪ এ (৭৪০০ মিটার)। বাকিবেলা বিশ্রাম করে রাত নামতেই শুরু হয় তাদের চূড়ার দিকে যাত্রা। আর ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরেই তারা পৌঁছে যান পর্বত শীর্ষে।

শিখরে এই দু’জনের সাথে গাইড হিসেবে ছিলেন বীরে তামাং এবং ফূর্বা অংডি শেরপা। তারা এখন চেষ্টা করবেন যত দ্রুত যতটা সম্ভব নিচে নেমে আসতে। নেটওয়ার্কের বাইরে থাকায় শিখরের ছবি পেতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

ফরহান জামান আরো বলেন, ‘তানভীর আরো অনেক পর্বতে যেতে চায়। আর বাবরও চায় ১৪টি আটহাজারি শৃঙ্গের সবকটিতেই চড়তে। সবেমাত্র ৪টি হলো, বাকি আছে আরো ১০টি। আশা করি, পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চলতে থাকবে পর্বত থেকে পর্বতে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডয়ন উৎসব।’

এই দুঃসাহসিক অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন সামুদা, ভিজুয়াল নিটওয়ারস, গিগাবাইট বাংলাদেশ, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, সিনোভেস্ট, সিয়েরা-রোমিও, আদিবা ফুটওয়্যার, ফোরএস অ্যাডভান্স টেকনোলজিস, জেনোভার্স, সোর্স এসোসিয়েটস, আইলেট ব্যাংকার্স, কাজী এগ্রো এবং ফ্রিয়েসভা।

বাবর আলী দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স-এর সাধারণ সম্পাদক এবং তানভীর আহমেদ এই ক্লাবের মাউন্টেনিয়ারিং বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত। তানভীর গতবছর অন্যতম টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম সামিট করেন, প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে যেই পর্বত ২০২২ সালে সামিট করেছিলেন বাবর।

এর আগে বাবর আলী এভারেস্ট, লোৎসে, অন্নপূর্ণা-১ জয় করেছেন। এবার মানাসলুতে তার সাফল্য বাংলাদেশের পতাকাকে নিয়ে গেল আরো উচ্চতায়।

উল্লেখ, বৃহস্পতিবার ‘মানাসলু’ জয় করেছেন বাংলাদেশী আরেক পর্বতারোহী তৌফিক আহমেদ তমাল।

মানাসলু পশ্চিম-মধ্য নেপালের মানসিরি হিমালে অবস্থিত। সংস্কৃত শব্দ ‘মনসা’ থেকে নামটির উৎপত্তি, যার অর্থ ‘বুদ্ধি’ বা ‘আত্মা’। তাই মানাসলু মানে দাঁড়ায় ‘আত্মার পর্বত’। ১৯৫৬ সালে জাপানি পর্বতারোহী তোশিও ইমানিশি এবং গ্যালজেন নরবু প্রথম এই পর্বতের চূড়ায় পৌঁছান। উচ্চতায় এটি অষ্টম হলেও, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী পর্বতগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।