জীবন্ত জাদুঘর ইস্তাম্বুলের রাজকীয় আকর্ষণ

ইস্তাম্বুল আসলে কেবল এক শহর নয়; এটি সময়ের ওপরেই দাঁড়ানো এক মঞ্চ, যেখানে অতীত আর বর্তমান একসঙ্গে অভিনয় করে। একবার এ শহরে গেলে বুঝবেন, কেন এ শহরকে রাজকীয় আকর্ষণ বলা হয়।

রাজিয়া খাতুন
দুই মহাদেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক উপদ্বীপ একেবারেই কাকতালীয়ভাবে জন্মায়নি
দুই মহাদেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক উপদ্বীপ একেবারেই কাকতালীয়ভাবে জন্মায়নি |আলজাজিরা

অতীতের পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই যদি বর্তমানের প্রাণবন্ত কোলাহলে ঢুকে যান কেমন অনুভূতি হবে! ঠিক সেরকমই এক অনুভূতির স্বাদ পাওয়া যায় ইস্তাম্বুল ভ্রমণে গেলে। শহরটি যেন জীবন্ত এক জাদুঘর, যেখানে ভূগর্ভের রহস্যময় নিদর্শন যেমন আছে, তেমনি আছে সুগন্ধে ভরা রান্নাঘরের আহ্বান। ইতিহাস আর আধুনিকতার এই অপূর্ব মিশেলই ইস্তাম্বুলকে করে তুলেছে অনন্য।

দুই মহাদেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক উপদ্বীপ একেবারেই কাকতালীয়ভাবে জন্মায়নি। বসফরাস, গোল্ডেন হর্ন আর মারমারা সাগরের ঢেউয়ে ঘেরা এই ভূমিকে বেছে নেয়া হয়েছিলো বিশ্ব শাসনের কেন্দ্র হিসেবে। তাই আজও ইউনেস্কো ঘোষিত এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি ঘিরে আছে হাজার বছরের পুরনো দেয়াল।

পাথরে বাঁধানো সরু গলিতে হাঁটতে হাঁটতে আপনি প্রাচীন দুই সাম্রাজ্যের— পূর্ব রোমান (বাইজেন্টাইন) আর অটোমান স্মৃতির মুখোমুখি হবেন। মাথার ওপরে সুউচ্চ গম্বুজ আর সামনে রাজকীয় ফটক এবং সংকীর্ণ গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে আপনি যেন এক মুহূর্তে চলে গেছেন অতীতের বিজেতাদের ভিড়ের মধ্যে।

আজকের ইস্তাম্বুল শুধু সেই ইতিহাসে থেমে নেই, বরং নতুন সাজে সেজে উঠেছে। দর্শনার্থীরা আমোদ-প্রমোদের মাধ্যম হিসেবে শহরটির প্রাচীন রাজকীয় জাঁকজমক উপভোগ করতে পারেন। বর্তমানে প্রাসাদগুলো রূপ নিয়েছে জাদুঘর আর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, আবার অটোমানদের রাজকীয় রান্না ফিরে এসেছে আধুনিক কায়দায়। প্রতিটি তুর্কি কফির কাপে, বসফরাসের প্রতিটি দৃশ্যে এবং এই শহরকে একসময় যে সাম্রাজ্যগুলো নিজের বাড়ি বলে ডাকতো তাদের প্রতিটি ফিসফিসানিতে ইতিহাস আর আধুনিকতা মিলে যায় এক অবিচ্ছেদ্য সেতুবন্ধনে।

হাগিয়া সোফিয়া, তোপকাপি প্রাসাদ কিংবা সুলতান আহমেত (ব্লু মসজিদ) ও সুলাইমানিয়ের রাজকীয় মসজিদগুলোর মতো বিখ্যাত নিদর্শন ঘুরে দেখার পরও যারা নতুন কিছু খুঁজছেন, তাদের জন্য রয়েছে অনন্য অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার- যা তুলে ধরে শহরের আসল চরিত্র, দেয় রাজকীয় ঐশ্বর্যের এক অনন্য ছোঁয়া।

Istanbul

প্রাসাদের অতিথি হয়ে উঠুন

কল্পনা করুন, চোখ মেলে জেগে উঠছেন অপূর্ব বসফরাসের ঝিলমিল পানির দিকে তাকিয়ে। আর সকালে চা চুমুক দিচ্ছেন সবুজে ভরা পাহাড়ঘেরা শান্ত আকাশের সামনে বসে।

তারপর নিজস্ব জেটি থেকে নেমে একটি দৃষ্টিনন্দন নৌকায় চড়ে চলে গেলেন পুরনো শহরের ভ্রমণে। বসফরাসের তীরে অবস্থিত কোনো প্রাক্তন অটোমান প্রাসাদে থাকার বুকিং দিলে এমন অভিজ্ঞতা তো পাবেনই, সাথে থাকবে আরও অনেক কিছু।

১৯শ শতকে ইস্তাম্বুল ঐতিহাসিক উপদ্বীপ ছাড়িয়ে বাড়তে শুরু করে, যখন অটোমান দরবার টপকাপি প্রাসাদ ছেড়ে আধুনিক উপকূলীয় প্রাসাদ ও গ্রীষ্মকালীন অট্টালিকায় চলে যায়। আজ সেই প্রাসাদগুলোর কিছু রূপ নিয়েছে আড়ম্বরপূর্ণ পাঁচতারকা হোটেলে, যেখানে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় ঠিক রাজকীয় মর্যাদায়।

গোপন টিপস : বসফরাসের ধারে অবকাশযাপন করতে চাইলে চলে যান ওর্তাকোয়ে। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে তুলুন একদম পোস্টকার্ডের মতো সুন্দর ছবি—যেখানে থাকবে বিখ্যাত ওর্তাকোয়ে মসজিদ আর পেছনে প্রথম বসফরাস সেতু। রাতে অবশ্যই নিজেকে উপহার দিন সী-ফুড, নানা রকম মেজে (গরম ও ঠান্ডা পদ), আর রাকি (স্থানীয় বিখ্যাত মৌরির স্বাদের পানীয়) দিয়ে সাজানো ভোজ। সমুদ্রপাড়ের আভিজাত্যপূর্ণ রেস্টুরেন্টে বসে এমন এক ভোজন সত্যিই ইস্তাম্বুল ভ্রমণের এক অপরিহার্য এক অভিজ্ঞতা হতে পারে।

Istanbul-04

জলপথে মহাদেশ ভ্রমণ করুন

বোসফরাস ইস্তাম্বুলের প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত। ইউরোপ ও এশিয়াকে সংযুক্ত করা এই ৩০ কিমি দীর্ঘ প্রণালীটি ঘুরে দেখার জন্য আপনি একটি আরামদায়ক বোট ট্যুরে যেতে পারেন। পথে আপনি উপভোগ করতে পারবেন দুলমাবাহ্চে প্রাসাদ এবং অটোমান যুগের সুন্দর জলতীরবর্তী প্রাসাদগুলো, যা ইয়ালিস নামে পরিচিত।

আপনি চাইলে ঘনঘন আসা-যাওয়া করা কমিউটার ফেরি ব্যবহার করে জেলেদের প্রাক্তন গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে পারেন—যেমন আর্নাভুতকোই, বেবেক, ক্যান্ডিলি এবং আনাদোলুহিসারি। যা আজ ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে মনোরম উপকূলীয় এলাকা। আরও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জন্য আপনি একটি ছোট বোট ভাড়া করে সূর্যাস্ত বা চাঁদের আলোয় নৌভ্রমণ উপভোগ করতে পারেন।

গোপন টিপস : অটোমান সম্রাটরা কীভাবে স্টাইলিশ নৌযাত্রা করতেন তা জানতে চাইলে বেসবিকতাশের নেভাল মিউজিয়াম পরিদর্শন করুন। এখানে রয়েছে ১৯শ’ শতকের সুন্দরভাবে নির্মিত কাঠের রো-বোট (Caiques) সংগ্রহ, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টির দৈর্ঘ্য ৩০ মিটার পর্যন্ত। কাঠের তৈরি বিশাল দোতলা নৌকাগুলোতে একসময় অটোমান সুলতানরা ভেসে বেড়াতেন।

Istanbul-02

শহরের নিচে অন্য এক জগৎ-এ প্রবেশ করুন

ইস্তাম্বুলের ব্যস্ত রাস্তাগুলোর নিচে লুকিয়ে আছে প্রাচীন প্রাচ্য রোমান (বাইজেন্টাইন) ধন-সম্পদের জগৎ। সুলতানাহমেত ও বোয়াজিত এলাকায় দোকান ও হোটেলের বেসমেন্টগুলো বেশিরভাগই প্রাচীন চ্যাপেল, আগোরা এবং রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের সাথে সংযুক্ত।

সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ৬ষ্ঠ শতাব্দীর বাসিলিকা সিস্টার্ন। এখানে প্রবেশের টিকিট দিয়ে আপনি মার্বেল স্তম্ভের মাঝে লাইট শো এবং আধুনিক শিল্পকর্ম উপভোগ করতে পারেন। শেরেফিয়ে ও বিনবির দিরেক সিস্টার্নগুলো নিয়মিতভাবে ক্লাসিক্যাল মিউজিক কনসার্ট আয়োজন করে এই চমকপ্রদ ভূগর্ভস্থ পরিবেশে।

গোপন টিপস : আরেকটি চমৎকার স্থান হলো সুলতানাহমেত স্কোয়ারের নিকটে গ্রেট প্যালেস মোজাইকস মিউজিয়াম। এখানে ৪৫০–৫৫০ খ্রিস্টাব্দের সুন্দর মোজাইক রয়েছে, যা প্রাচীন বিজেন্টাইন রাজপ্রাসাদের উঠোনে সাজানো ছিল। যদিও প্রাসাদের অনেক অংশ এখনো মাটির নিচে, এসব মোজাইক প্রাচীন যুগের সৌন্দর্যের এক ঝলক দেখায়।

হামামে শরীর-মন জুড়ান

রোমান যুগ থেকে হামামে গোসল শুদ্ধি ও বিশুদ্ধতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হিসেবে বিবেচিত হতো। পরে অটোমানরা এটি আরও উন্নত ও সংস্কৃতির অংশ করে তোলেন।

ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক হামামগুলো যেমন চেম্বারলিতাস, গালাতাসারায়, কাগালোঘু, হুররম সুলতান এবং কিলিচ আলি পাসা আপনাকে মার্বেল স্টিম চেম্বার ও আরামদায়ক ফোম ম্যাসাজের মাধ্যমে এক বিলাসবহুল অভিজ্ঞতা দেয়।

আধুনিক বিলাসবহুল হোটেলগুলোতেও এই ক্লাসিক ডিজাইন অনুপ্রাণিত ছোট হামাম রয়েছে। এখানে স্নান করলে আপনার ত্বক শিশুর মতো নরম ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

গোপন টিপস : জানেন কি, হামামে সমকালীন শিল্পকর্মও দেখা যায়? সম্প্রতি সংস্কার করা ৫০০ বছরের পুরনো জেইরেক চিনিলি হামাম একটি হামাম ও প্রদর্শনী স্থানের সংমিশ্রণ। শিল্প ও সুস্থতার প্রতি আগ্রহী যেকোনো দর্শকের জন্য এটি একটা আদর্শ ভ্রমণের স্থান।

Istanbul-03

গ্র্যান্ড বাজারের রঙিন গোলকধাঁধায় হারিয়ে যান

ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজারে গেলে করলে আপনি ইতিহাস ও সংস্কৃতির জাদুময় জগতে প্রবেশ করবেন।

বিশ্বের প্রাচীন ও বৃহত্তম বাজারগুলোর একটি, ১৫শ শতকের এই গোলকধাঁধায় ৪,০০০-এর বেশি দোকান রয়েছে। এখানে হাতে বানানো গহনা, রঙিন কাপড়, অনন্য অ্যান্টিক সামগ্রী এবং তুর্কি স্নানের সরঞ্জাম পাওয়া যায়।

বাজারের ব্যস্ত করিডোরের ওপারে লুকিয়ে আছে হান্স। যা দ্বারা ঐতিহাসিক শহুরে সরাইখানাগুলোকে বোঝায়, যেখানে কারিগররা তাদের প্রাচীন শিল্পকর্ম তৈরি কাজ করেন।

গ্র্যান্ড বাজারের সবচেয়ে পুরনো অংশ চেভাহির বেদেস্টেনি (গহনার বাজার) ঘুরে দেখুন, যেখানে আপনি গহনা, ক্লাসিক ঘড়ি এবং ক্যালিগ্রাফি শিল্প খুঁজে পাবেন। এরপর স্যান্ডাল বেদেস্টেনি ঘুরে রঙিন কার্পেট, কিলিম এবং অন্যান্য সুন্দর কাপড় দেখুন।

গোপন টিপস : পাশেই আছে স্পাইস মার্কেট। এখানে পাওয়া যায় সুগন্ধি মসলা, লোভনীয় লকুম (তুর্কি মিষ্টি)। এখানে প্রবেশ করলে যেন ঘ্রাণের ঝড় বয়ে যায়—দারচিনি, গোলাপ জল, শুকনো ফল, বাদাম আর সদ্য তাজা কফির গন্ধে ভরে যায় চারদিক।

অটোমান রাজকীয় রান্না উপভোগ করুন

ইস্তাম্বুল ছিলো দুই সাম্রাজ্যের রাজধানী। তাই এর রান্নাঘরও ছিল রাজকীয়। তখনকার সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের কারণে প্রাসাদের রান্নাঘরে মধ্যপ্রাচ্য ও বলকান থেকে আসা উপকরণ, মসলা ও রান্নার কৌশল ব্যবহার হতো। দক্ষ শেফরা এগুলোকে অসাধারণ রেসিপিতে রূপান্তর করতেন। আজও ইস্তাম্বুলের রেস্টুরেন্টগুলোতে এই ঐতিহ্যবাহী স্বাদ উপভোগ করা যায়।

গত কয়েক দশকে শেফরা অটোমান প্রাসাদের খাবার পুনরুজ্জীবিত করছেন। ঐতিহাসিক উপদ্বীপের কিছু রেস্টুরেন্টে আপনি খেতে পারবেন মেলন বা কোয়িন্সের মাংস ভর্তি বা ফিলো পেস্ট্রিতে বাঁধা হাঁসের মতো বিশেষ খাবার। খাবারের সঙ্গে গোলাপ বা অনারস্বরূপ শারবত খেলে আসল সম্রাজ্যের স্বাদ পাওয়া যায়।

গোপন টিপস : মিশেলিন গাইডে তালিকাভুক্ত কিছু রেস্তোরাঁয় প্রাসাদের রান্নাঘরের আর্কাইভ দেখে বানাচ্ছে মেনু। এর মধ্যে একটি রয়েছে ঐতিহাসিক হামামের ভেতর।

ইস্তাম্বুল আসলে কেবল এক শহর নয়; এটি সময়ের ওপরেই দাঁড়ানো এক মঞ্চ, যেখানে অতীত আর বর্তমান একসঙ্গে অভিনয় করে। একবার এ শহরে গেলে বুঝবেন, কেন এ শহরকে রাজকীয় আকর্ষণ বলা হয়।

আল-জাজিরা অবলম্বনে।