প্রকৃতিতে শীতের ছোঁয়া লাগার সাথে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখি। অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চর বিজয়। আশপাশের মানুষ বিরক্ত না করায় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে চর বিজয়কে বেছে নিয়েছে পাখিরা। শীত আসা মানেই অতিথিদের আগমন। শূন্যে ডানা মেলে দল বেঁধে আসে তারা। নীল পানি ছুঁয়ে কখনো লুটোপুটি খায়, কখনো বা খাবারের খোঁজে ইতিউতি ঘোরে।
মানুষের খুব একটা বিচরণ না থাকায় শীতের শুরুতে কুয়াকাটা-সংলগ্ন সমুদ্রের মাঝে জেগে ওঠা এ দ্বীপটিতে নানা প্রজাতির রং-বেরঙের পাখির আগমন ঘটেছে। দেখলে মনে হবে যেন পাখির মেলা বসেছে। এসব পাখি মেতেছে খুনসুটি আর জলকেলিতে। আবার কোনো পাখি বালু চরে খাবার সংগ্রহ করতে ব্যস্ত রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো পাখি দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। একই সাথে এ দ্বীপটিতে রয়েছে লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ। এসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে আগত পর্যটকরা প্রতিনিয়ত ছুটে যাচ্ছেন চর বিজয়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ হাজার একর আয়তন নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠে এ দ্বীপটি। কুয়াকাটা সৈকত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে এর অবস্থান। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরেও শীতের শুরুতে এই দ্বীপটিতে আশ্রয় নিয়েছে জুলফি পানচিল, গাংচিল, ধূসর মাথা টিটি, সিথি হাঁস, খুন্তে হাঁস, খয়রা চখাচোখি, ছোট পানকৌরী, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ং হাঁস, ধূসর বগা, পাতি হাঁস, কালো মাথা গাঙচিল, ছোট ধলাজিরিয়া, ছোট নর্থ জিরিয়া, গো বগা, মেটে রাজ হাঁস, পাতি বাটান, চেগা, সরালি, বড় সরালি, চখাচখি, শামুকখোল, পানকৌড়ি, মাথামোটা টিটি, হটটিটি, কবুতর, জলমোরগ ও নানা প্রজাতির বক, পাতি চেগাসহ নানান প্রজাতির পাখি।
সুদূর সাইবেরিয়াসহ দূর দূরান্ত থেকে আসা এসব অতিথি পাখি বছরের নভেম্বরের প্রথম দিকেই আসতে শুরু করে এবং মার্চ পর্যন্ত অবস্থান নেয় দ্বীপটিতে। নানা প্রজাতির পাখি খাবারের খোঁজে উড়াউড়ি করছে, পানিতে ডুব দিয়ে খাবার খুঁজছে। ক্লান্ত পাখিরা বিশ্রাম নিচ্ছে পুঁতে রাখা খুঁটি ও জেগে ওঠা চরে। একটু উষ্ণতার খোঁজে ছুটে আসা এসব নানা রঙের পাখির আগমনে তাই চর বিজয় হয়ে ওঠে চমকপ্রদ।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি দ্বীপটিতে অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে। প্রতিদিন পাখির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির এক নান্দনিক সৌন্দর্য। নানা প্রজাতির রং-বেরঙের পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত থাকে বিশাল এই দ্বীপটি।
তবে দ্বীপটির সঠিক তদারকিতে তৈরি হবে একটি নতুন সমভূমি। যাকে ঘিরে কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পে তৈরি হবে আরেক ভিন্ন মাত্রা। এমন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন পর্যটকরা। এদিকে এসব পাখি শিকারকে নিরুৎসাহিত করার জন্য মাঠে রয়েছে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ও বন বিভাগ।
স্থানীয় পর্যটন কর্মীরা জানায়, দিগন্ত জোড়া আকাশ, আর সমুদ্রের নীল জলরাশি আছড়ে পড়ছে কিনারায়। জেগে ওঠা দ্বীপটির নাম ‘চর বিজয়’ রাখা হলেও গভীর সাগরে মাছধরা জেলেদের কাছে ‘হাইরের চর’ নামে পরিচিত। ইতোমধ্যে দ্বীপটিতে বন বিভাগ ও স্থানীয় সেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু ম্যানগ্রোভ প্রজাতির চারা গাছ রোপণ করা হয়েছে। মূলত ২০১৭ সাল থেকে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এই চরের পাখি আর লাল কাঁকড়ার সমাগমে আকৃষ্ট হয় সব শ্রেণির পর্যটকরা। তবে চর বিজয় ভবিষ্যতে সেন্টমার্টিনের মতো জনপ্রিয়তা পাবে বলে মনে করেন তারা।
দ্বীপটি ঘুরে এসে পর্যটকরা বলেন, চারদিকে সাগরের অথৈ পানি। এরই মধ্যে আকাশ ও মাটি একসাথে মিতালি তৈরি করেছে।
পর্যটক আরফাত হোসাইন জানান, ’কুয়াকাটায় এই প্রথমবার ভ্রমণে এসেছি। তবে সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চর বিজয় সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। সবমিলিয়ে ‘চর বিজয়’ দ্বীপটি এক অপার সম্ভাবনাময়।’
পর্যটক আহসান হাবিব জানান, ’সত্যি এ দ্বীপটি ঘুরে মুগ্ধ হয়েছি। চারদিকে বিশাল সমুদ্রের মাঝখানে একটি দ্বীপ। আর সেখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অতিথি পাখি ও লাল কাঁকড়া। তবে এই দ্বীপে পর্যাপ্ত গাছ লাগানো দরকার, যাতে করে পাখিদের বাসস্থান তৈরি হয়।’
ট্যুরিজম ব্যবসায়ী মো: জনি আলমগীর বলেন, ’কুয়াকাটা থেকে ট্যুরিস্ট বোটে যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এ সময় পর্যটকরা উপভোগ করতে পারবেন সমুদ্রের সৌন্দর্য। বিস্তীর্ণ জলরাশি ও সমুদ্রের বিশালতা ভ্রমণে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই স্বাগত জানাবে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। আর স্বচ্ছ পানিতে সামুদ্রিক মাছের ছোটাছুটি নিমেষেই সারাদিনের ক্লান্ত মনকে ভরিয়ে দেবে অন্যরকম আনন্দ। তবে এ দ্বীপে নেই কোনো দোকানপাট, তাই খাবার ও পানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে যেতে হবে।’ সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরে আসতে হবে বলে তিনি জানান।
কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন কুটুম-এর সহসভাপতি হোসাইন আমির বলেন, কুয়াকাটার কাছে চর বিজয় দ্বীপে শীতকালের শুরুতেই অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে। এই সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির লাখ লাখ পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে দ্বীপটি। এ দ্বীপটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্ষা মৌসুমের ছয় মাস চরটি হাঁটু পানিতে ডুবে থাকে এবং শীত মৌসুমে ধু-ধু বালু নিয়ে জেগে ওঠে। এ সময়ে জেলেরা অস্থায়ী বাসা তৈরি করে মাছ শিকার এবং শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করেন।
জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বর মাস থেকে চর বিজয়ে বেশি পাখি আসতে শুরু করে। নানা প্রজাতির রং-বেরঙের পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত থাকে বিশাল এই দ্বীপটি।
মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা এ কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, দ্বীপটিতে রোপণকৃত গাছগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। সুফল প্রকল্পের আওতায় বনায়নের কার্যক্রম চলছে। চর বিজয়ে বনায়ন তৈরি হলে অতিথি পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে উঠবে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।



