মীরসরাইয়ের লুকানো রত্ন খৈয়াছড়া ঝর্ণা

খৈয়াছড়া ঝর্ণার ইতিহাস প্রায় ৫০ বছরের। চার দিকে পাহাড় আর গাছপালায় ঢাকা ও দুর্গম হওয়ায় মানুষ পাহাড়ের সন্ধান পেয়েছে অনেক পরে । প্রকৃতির নিজ খেয়ালেই কোনো এক সময় পাহাড়ি ঢলের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ঝর্ণাটি।

মিজানুর রহমান

Location :

Mirsharai
খৈয়াছড়া ঝর্ণা
খৈয়াছড়া ঝর্ণা |সংগৃহীত

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, ও সে সকল দেশের রানি সে যে – আমার জন্মভূমি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা এই কথাগুলো যেন বাস্তব হয়ে ধরা দেয় পাহাড় ও ঝর্ণার সৌন্দর্য হয়ে। মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণা যেন সেই সৌন্দর্যের এক জীবন্ত উদাহরণ।

চট্রগ্রামের মীরসরাই উপজেলায় গেলে দেখা মেলে প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য। সেখানকার নাপিত্তাছড়া, সহস্রধারা, কমলদহ, ঝরাঝরি, খৈয়াছড়া ঝর্ণাগুলো সেই সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।

খৈয়াছড়া ঝর্ণা অন্যসব ঝর্ণা থেকে একদম আলাদা। এ ঝর্ণায় রয়েছে মোট নয়টি বড় ধাপ অর্থাৎ ক্যাসকেড যা বাংলাদেশের অন্য কোনো ঝর্ণাতে নেই। এজন্য খৈয়াছড়াকে বলা হয় ‘ঝর্ণা রাণী’। মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নে অবস্থিত হওয়ায় এর নামকরণ করা হয় “খৈয়াছড়া ঝর্ণা”। স্থানীয়দের কাছে ঝরনাটি ‘চতল’ নামে পরিচিত।

ঝর্ণাটির অবস্থান চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর দিকে এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে।

খৈয়াছড়া ঝর্ণার ইতিহাস প্রায় ৫০ বছরের। চার দিকে পাহাড় আর গাছপালায় ঢাকা ও দুর্গম হওয়ায় মানুষ পাহাড়ের সন্ধান পেয়েছে অনেক পরে । প্রকৃতির নিজ খেয়ালেই কোনো এক সময় পাহাড়ি ঢলের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ঝর্ণাটি।

Khoiachhara-02

২০১০ সালে বড়তাকিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলকে সরকারি জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সে সময় থেকে উদ্যানের প্রধান প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে আবির্ভূত হয় ঝর্ণাটি।

ঝর্ণাটি পাহাড়ের একদম ভেতরে হওয়ায় ঝর্ণা পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই যেতে হয়। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছাতে গ্রামের ভিতর দিয়ে ১০-১৫ মিনিট হাঁটতে হয়।

আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি মেঠো পথ আর দুর্গম ঝিরিপথ, উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড় আর নাম না জানা অসংখ্য গাছের সমারোহে দেখে মনে হবে এ যেন এক সবুজ গালিচা। মাঝে মাঝে দেখা মিলবে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ঘর আর জুম চাষ।

নয়টি বড় বড় ক্যাসকেড বা ধাপ প্রতিটি পাড়ি দিতে গিয়ে দেখা মিলবে আলাদা সৌন্দর্যের। অন্তত চারটি পাহাড় পাড়ি দেয়ার পর ঝর্ণার দেখা পাওয়া যাবে। কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা দুর্গম পথ ধরে এগোতে হয়। যার প্রতিটা ধাপেই রয়েছে বিপদের আশঙ্ক্ষা। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে যেন সব হার মেনে যায়।

ট্রেকিংয়ের সময় হাঁটার সুবিধার্থে বাঁশের লাঠি এবং পায়ে এংলেট পড়ে নিতে হয়। ঝিরিপথের শুরুতেই এগুলো স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়। লাঠি দিয়ে ঝিরিপথের গভীরতা মেপে সাবধানে এগোতে হয় সামনের দিকে। পাথরে ঢাকা ঝিরিপথগুলো প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেও আশেপাশের সৌন্দর্য যেন সেই প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে সামনে এগোতে সাহায্য করে।

Khoiachhara-03

ঝরনার অনেকটা দূর থেকেই এর ঝমঝম শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এ যেন এক অনন্য সুখ, যা আর কোথাও পাওয়া যায় না। শত বাঁধা পেরিয়ে ঝর্ণার কাছে গেলে সেই সুখ আর আনন্দ যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সবুজে ঢাকা পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা পানির ধারা যেন সৌন্দর্যের অন্য রূপ। ঝর্ণার শীতল পানিতে গা এলিয়ে দিলে যেন শরীরটা সতেজ হয়ে ওঠে। এমন অপরূপ সৌন্দর্য যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে চায় না।

খৈয়াছড়া ছাড়াও আশেপাশের অন্যান্য ঝর্ণাগুলোও দেখতে অসাধারণ। দর্শনার্থীরা সবগুলো ঝর্ণার সৌন্দর্যেই বিমোহীত হতে বাধ্য।

ঝর্ণা থেকে ফেরার পথটা আরও বিমুগ্ধ করে। খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে নামার যে অভিজ্ঞতা তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। নির্জন ও সবুজে ঢাকা পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা যা সোজা নিচে নেমে গেছে। একটু অসাবধান হলেও নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তবুও এ পথের সৌন্দর্য মনের মধ্যে দাগ কেটে যায়।

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

পাহাড়ে ওঠার আগে গ্রামের শেষ প্রান্তে বেশকিছু ছোট ছোট খাবার হোটেল রয়েছে। সেখানে খাবার অর্ডার দিয়ে গেলে ঝর্ণা দেখে ফেরার পথে খাওয়া যায়। পাশাপাশি সাথে নিয়ে যাওয়া ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিরাপদে রাখা যায়। এখানে স্বল্পমূল্যে আনলিমিটেড ভাত-ডালসহ ১০০ টাকায় ফার্মের মুরগি, ১৩০ টাকায় দেশি মুরগির গোশত পাওয়া যায়। সঙ্গে আলুভর্তা আর সালাদ যোগ করলে খরচ দাঁড়ায় ১৪০ টাকা। তবে বিকেল ৫টার পর খাবার হোটেলগুলো অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দেয়।

বড়তাকিয়া বাজারে থাকার কোনো হোটেল না থাকায় সীতাকুণ্ড বা চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে থাকতে হবে।

Khoiachhara-04

ঝর্ণা দেখার উপযুক্ত সময়

শুকনা মৌসুমে পানির প্রবাহ কম থাকায় ঝর্ণার আসল সৌন্দর্য দেখা যায় না। এজন্য খৈয়াছড়া ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য দেখার জন্য বর্ষাকালকে বেছে নিতে হবে। এসময় পানির প্রবাহ বেশি থাকে। ফলে ঝর্ণা তার নিজস্ব রূপের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রদর্শন করে।

তবে এসময় পাহাড়ি পথের বিপদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। পানির ঢল বেশি হলে ঝিরিপথ পাড়ি দেয়া বিপজ্জনক হবে। এজন্য বর্ষার শুরু বা শেষের দিকটা ঝর্ণা দেখার উপযুক্ত সময়।

যেভাবে যাওয়া যায়

প্রথমে মীরসরাই যাওয়ার জন্য চট্টগ্রামগামী বাসে উঠতে হবে। সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে লোকাল বাসে যাওয়া যায়। ট্রেনে গেলে ফেনী স্টেশনে নেমে তারপর চট্টগ্রামের বাসে উঠতে হবে। এরপর মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের কাছে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা হেঁটে পাহাড় পর্যন্ত যেতে হবে।

আবার চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে সীতাকুণ্ড স্টেশনে নেমে বাসে মীরসরাই যাওয়া যায়।

সতর্কতা

দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় ঝর্ণা দেখতে গিয়ে অনেকে বিভিন্ন ধরনের বিপদের মুখোমুখি হন। এমনকি মাঝে মাঝে প্রাণহানীর মতো ঘটনাও ঘটে। এজন্য সতর্ক থাকতে হবে। ঝুঁকি এড়াতে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এছাড়া কয়েক জনের গ্রুপ করে যাওয়া যেতে পারে।

গাছপালায় ঘেড়া পাহাড়ের ভিতরে ঝর্ণার অবস্থান হওয়ায় দিনের বেলাতেও পর্যাপ্ত আলো দেখা যায় না। এ কারণে দুপুরের আগে গিয়ে সূর্য ডোবার আগেই ফিরে আসা ভালো। এছাড়া ঝিরিপথে পর্যাপ্ত ছোট-বড় পাথর থাকায় ট্রেকিংয়ের সময় সতর্ক থাকতে হবে। পা পিছলে পাথরের উপর পড়লে কিংবা পা পাথরের খাদে পড়লে বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।