ভারতে আগরওয়াল সঙ্কট, সম্পদ আছে সঙ্গী নেই

কান্না চেপে নির্মলা বলেন, আমাদের সব আছে। ওর বাবা মাসে ২০ হাজার এবং ছেলে মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করে। তবু জানি না কেন কেউ আমার ছেলেকে বিয়ে করতে চায় না। ওর বয়স ইতোমধ্যেই ৩০। আমরা শেষ আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম।

মিজানুর রহমান

নির্মলা নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সাথে আছেন তার স্বামী এবং ছেলে হিমাংশু। ছেলের জন্য পাত্রির খোঁজে পরিবারটি হরিয়ানা রাজ্যের মাহেন্দ্রগড় জেলার নারনৌল শহর থেকে জিন্দে (হরিয়ানা রাজ্যের জেলা শহর) এসেছিল। জিন্দের শ্রী শ্যাম গার্ডেনে আয়োজিত আগরওয়াল সম্মেলন হয়তো অবশেষে হিমাংশুর জন্য পাত্রী এনে দেবে এটাই ছিল তাদের শেষ আশা।

নির্মলার হাতে একটি পুরনো বুকলেট যার প্রতিটি পাতায় আছে নাম, ছবি আর বায়োডাটা (ছেলের জীবনবৃত্তান্ত)। তবে পাত্রী না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে তাদের।

কান্না চেপে নির্মলা বলেন, আমাদের সব আছে। ওর বাবা মাসে ২০ হাজার এবং ছেলে মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করে। তবু জানি না কেন কেউ আমার ছেলেকে বিয়ে করতে চায় না। ওর বয়স ইতোমধ্যেই ৩০। আমরা শেষ আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম।

নির্মলা একা নন। শত শত বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাত সেপ্টেম্বর জিন্দের শ্রী শ্যাম গার্ডেনে একত্র হয়েছিল নর্থ ইন্ডিয়া লেভেলের পরিচয় সম্মেলনে। যা আয়োজন করেছিল অল ইন্ডিয়া আগরওয়াল সমাজ, হরিয়ানা।

Aggarwal Cisis-02

আগরওয়ালারা ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। আগরওয়ালারা সংখ্যায় আনুমানিক পাঁচ দশমিক ছয় মিলিয়ন বা ৫৬ লাখ। ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে সাফল্যের সাথে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা। ২০২৫ সালের হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট (Hurun India Rice List) অনুযায়ী, আগরওয়াল ও গুপ্তা পরিবারগুলোর দেশের সবচেয়ে মূল্যবান পারিবারিক ব্যবসার তালিকায় ১২টি করে নাম আছে।

যদিও ব্যবসায় তারা শক্ত অবস্থানে আছে, বিয়ে করতে গেলে তাদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দেরিতে বিয়ের প্রবণতা বাড়ছে। ধন-সম্পদ, শিক্ষা আর আধুনিক চিন্তাধারা থাকলেও সঠিক সময়ে জীবনসঙ্গী পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে।

বিয়েতে দেরি হওয়ার সমস্যার সমাধান হিসেবে তারা আয়োজন করছে বিশাল পরিচয়-সম্মেলন। যে সম্মেলনে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অংশগ্রহণকারীরা একটাই স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছিলেন। একজন আদর্শ বউ, জামাই বা জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া।

সম্মেলনে ১৭টি রাজ্য এমনকি বিদেশ থেকেও এক হাজার ৫০০ এর বেশি যোগ্য প্রার্থী এসেছিলেন। সবাই খুঁজছিলেন ‘সঠিক মানুষটিকে’।

অনুষ্ঠানটি সাধারণত প্রতি পাঁচ বছরে একবার হয়। আখিল ভারতীয় আগরওয়াল সমাজ, হরিয়ানার সভাপতি রাজ কুমার গোয়েল অনুষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেন।

অনুষ্ঠানে হরিয়ানার মন্ত্রী বিজয় গোয়েল, পাঞ্জাবের বরিন্দর গোয়েল এবং আখিল ভারতীয় আগরওয়াল সংঘটনের জাতীয় চেয়ারম্যান প্রদীপ মিত্তাল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

আখিল ভারতীয় আগরওয়াল সমাজ, হরিয়ানার সভাপতি রাজ কুমার গোয়েল বলেন, এই সম্মেলন একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায় বিয়েকে সময়মতো উৎসাহিত করার। এভাবেই আমরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লড়াই করি। অপরাধ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াই করি। আমাদের সাংস্কৃতিক কাঠামোকে রক্ষা করি।

৫০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে সম্ভাব্য যোগ্য পাত্র-পাত্রীর বিস্তারিত তথ্য সহ একটি বুকলেট পাওয়া যায়। দুই পরিবার যদি পছন্দ করে, তারা নিজেদের মতো করে এগিয়ে যেতে পারে।

Aggarwal Cisis-03

হরিয়ানার ওপি জিন্দাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিব বিশ্বনাথন বলেন, এই মিশ্রণটাই (সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মিলন) অ্যাগরওয়াল সম্মেলনের বিশেষত্ব। এগুলো একদিকে যেমন আধুনিক, তেমনি আবার ঐতিহ্য মেনে চলে। যতটা সম্ভব পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো থাকলেও, তার ভেতরেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও বদলের সুযোগ আছে।

সম্মেলনের মঞ্চে প্রার্থীরা নিজেদের পরিচয় এবং আদর্শ সঙ্গীর শর্ত জানিয়ে দিচ্ছিল। এক যুবক বলছে তার সংস্কৃতিমনা মেয়ে চাই। অন্যদিকে ২৫ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষিকা প্রিয়া বানসালের ইচ্ছে সে আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে চায়। আবার তার সঙ্গী ধুমপান করতে পারবে না।

যেখানে ৩০ বছরের পরে বিয়ে করা ভারতের মধ্যে একটি “চাঞ্চল্যকর” প্রবণতা হয়ে উঠেছে, সেখানে রাজ কুমার গোয়াল চেষ্টা করছেন পরিচয় সম্মেলনের হারানো ঐতিহ্যকে আধুনিক, মর্যাদাপূর্ণ এবং কার্যকরভাবে পুনরুজ্জীবিত করার।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি আয়োজন করেছেন, “পরিচয় সম্মেলন। যেখানে যোগ্য ছেলেমেয়ে (এবং তাদের পরিবার) এক ছাদের তলে একত্রিত হয়।

সম্মেলনের অন্যতম আয়োজনকারী রাজ কুমার গোয়াল বলেন, প্রথমে বাবা-মা চায় ছেলের চাকরি হোক। তারপর ইঞ্জিনিয়ার হোক। তারপর আইএএস পাশ করুক। ততদিনে বয়স হয়ে যায়। তখন বিয়ে করতে দেরি হয়ে যায়।

তার মতে, এই সম্মেলনই এই সমস্যার একমাত্র প্রতিষেধক। এটিই একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায় বিয়েকে সময়মতো উৎসাহিত করার। এভাবেই আমরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লড়াই করি। অপরাধ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াই করি। আমাদের সাংস্কৃতিক কাঠামোকে রক্ষা করি।

গোয়াল বলেন, আগে মেয়েদের পুতুলের মতো পরিবেশন করা হতো। পাত্রপক্ষ মন্দিরে, হোটেলে বা ধর্মশালায় আসত। মেয়ে দেখত আর অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যেত। এটা ছিল অপমানজনক। আমি সেটা শেষ করতে চেয়েছিলাম।

২০০১ সালে ইন্দোরে (মধ্যপ্রদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী) একটি কমিউনিটি ম্যাচমেকিং উদ্যোগ দেখে অনুপ্রাণিত হই। এরপর আমরা চিন্তা করি কেন আমরা আমাদের অঞ্চলেও একই ধরনের উদ্যোগ না আনছি। যেখানে উপযুক্ত সঙ্গীর অভাব একটি নীরব মহামারির মতো হয়ে উঠেছে।

প্রথম আয়োজনটি অবশ্য সন্দেহ ও কটাক্ষের মুখোমুখি হয়। মানুষ বলেছিল, আমরা ছেলে-মেয়েদের মঞ্চে ডাকিয়ে তাদের অসম্মান করছি। এটি মর্যাদাহীন। কিন্তু আমরা জানতাম, যদি এখনই ব্যবস্থা না নেই, সামাজিক সংযোগের সূতা ছিন্ন হয়ে যাবে।

আজ তিনি এবং হরিয়ানা ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যের ৪৫০ এর বেশি স্বেচ্ছাসেবক প্রতি ২-৩ বছরে জেলা পর্যায়ে এই আয়োজন করেন। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর, একটি বৃহৎ উত্তর ভারতীয় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে সম্মেলনে মেয়েদের অংশগ্রহণে বড় পরিবর্তন এসেছে। মেয়েরা আর আগের মতো সম্মেলনে অংশগ্রহণে আগ্রহী নয়। সত্তর ও আশির দশকে ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ছিল মেয়ে। ২০০০ সালের মধ্যে ৫০-৫০ হয়ে যায়। আজ ৮০-৮৫ শতাংশ ছেলে। মাত্র ১৫-২০ শতাংশ নিবন্ধিত প্রার্থী মেয়ে।

তিনি বলেন, এর কারণ মেয়েদের শিক্ষা ও ক্যারিয়ার অগ্রগতি। মেয়েরা এখন বেশি শিক্ষিত। উচ্চ ডিগ্রি নেয়, ভালো চাকরি করে। মেয়েরা চায় বেশি যোগ্য, বেশি আয়ক্ষম বর।

কিন্তু ছেলেরা? ছেলেরা এখনো পিছিয়ে। অনেকেই পারিবারিক দোকানে আটকে আছে, ছোট ব্যবসায় আটকে আছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার মধ্যে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে।

এই সমস্যার সমাধানে গোয়াল সরকারকে মধ্যস্থ হবার ও ম্যাচমেকিং এবং সময়মতো বিয়েকে জাতীয় গুরুত্ব দেওয়ার জন্য লবিং করছেন।

তিনি বলেন, আমরা সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আমরা চাই প্রতিটি রাজ্য বিয়ের তথ্য সংগ্রহ শুরু করুক এবং সরকারি ম্যাচমেকিং অনুষ্ঠান আয়োজন করুক। তখনই বাবা-মা বুঝবেন বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি বিয়ে সময়মতো হয়, অপরাধ কমবে।

অখিল ভারতীয় আগরওয়াল সংগঠনের জাতীয় চেয়ারম্যান বা সভাপতি প্রদীপ মিত্তল বলেন, যতই প্রগতিশীল চিন্তাধারার হন, ২৫ বছর হলো বিয়ের আদর্শ সময়। তার চেয়ে বেশি বয়স হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি ধীরে ধীরে একটি সামাজিক ও চিকিৎসাগত জরুরি অবস্থা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ডাক্তাররা বলেন, ৩০-৩৫-৪০ বছর বয়সে বিয়ে করলে প্রজনন ক্ষমতা এবং আবেগিক বন্ধন প্রভাবিত হয়।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান সময়ে প্রচলিত প্রি-ওয়েডিং শুট (বিয়ের আগে ছেলে, মেয়ের অবাধ মেলামেশা) সমাজের জন্য বিপজ্জনক। ছেলে ও মেয়ে এক সপ্তাহের জন্য বাইরে যায়। একসাথে থাকে। আবেগগতভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। তারপর তারা ফিরে এসে পরিবারের কাছে সব জানায় এবং বিয়ের আগে সম্পর্ক ভেঙে যায়। আমি শত শত এমন ঘটনা দেখেছি।

প্রতিক্রিয়ায়, মিত্তল প্রি-ওয়েডিং শুট বন্ধ করার জন্য জাতীয় প্রস্তাব এনেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে এই ধরনের প্র্যাকটিসগুলো বিয়ের প্রতি বিশ্বাস ও পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করে। যত বেশি সম্পর্কগুলো অপ্রথাগত হয়, তত বেশি ভঙ্গুর হয়ে যায়।