হামিদ মীর
দরবেশ কে? আমরা দরবেশ বলতে যা বুঝি- তিনি এমন আল্লাহভীরু ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর জন্য দারিদ্র্যকে বরণ করেন। তিনি যত দরিদ্র হন, ততই খুশি হন। দরবেশকে আমরা পীর ও ফকির বলেও চিনে থাকি। প্রকৃত দরবেশ মানুষের কাছে কিছুই চান না। তিনি শুধু আল্লাহ তায়ালার কাছেই প্রার্থনা করেন।
তবে আজকাল এমন কিছু দরবেশের দেখা পাওয়া যায়, যারা সব সময় কারো না কারো কাছে কিছু চেয়েই থাকে। এমন কথিত দরবেশদের ব্যাপারেই আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, তোমার এই সরল সোজা বান্দা কোন দিকে যাবে? এখন তো বাদশাহি ও দরবেশিতেও ধোকা আছে।’
আমি এমন দুই তিনজনকে চিনি, যারা গর্বের সাথে নিজেদের দরবেশ বলে প্রচার করে থাকেন। কিন্তু তারা আল্লামা ইকবালকে অনেক অপছন্দ করেন। কেননা আল্লামা ইকবাল কবিতার মাধ্যমে কেবল দরবেশদের ব্যাপারেই জাতিকে সতর্ক করে যাননি; বরং তিনি প্রতারক বাদশাদের ব্যাপারেও সতর্ক করে গেছেন।
আল্লামা ইকবাল যেই দরবেশিকে প্রতারণা বলে গেছেন, তার মানদণ্ড কী? বর্তমানে প্রকৃত দরবেশের সংখ্যা খুবই কম। অন্য যাদেরকে পাওয়া যায়, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে দরবেশ বলে প্রচার করে থাকেন।
এমন স্ব-ঘোষিত দরবেশ বাহ্যিকভাবে নিরাপত্তা ও শান্তিকামী হিসেবে নিজেকে জাহির করে থাকেন। কিন্তু প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি মনে ঘৃণা পোষণ করে থাকেন। এরা যখন আলোচনা করেন, তখন তারা কাশ্মিরীদের স্বাধীনতা আন্দোলনকেও অস্বীকার করে বসেন। এই ন্যায্য আন্দোলনকে তারা ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক বুঝাপাড়ার জন্য প্রতিবন্ধক মনে করে থাকেন।
এই স্ব-ঘোষিত দরবেশরা আজকাল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকেও অপছন্দ করে থাকেন। তারা হামাসকে উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে গাজায় চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের পক্ষেও সাফাই গাইতে চান। এমনকি পাকিস্তানি সেনাদের গাজায় গিয়ে হামাসের বিরুদ্ধে কাজ করাতেও তারা কোনো মন্দ দেখেন না। অথচ পাকিস্তানি সেনারা এমন কোনো কাজে জড়াতে চান না, যাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষিত হয়।
ভবিষ্যতে এমন স্ব-ঘোষিত দরবেশ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিজ্ঞ ও মুকুটহীন সম্রাটদের মুখোশ খুলে যাবে, যারা গাজায় নিরাপত্তা রক্ষার নামে এমন বন্দোবস্তের পক্ষে কথা বলবে, যাতে প্রকারান্তরে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষিত হয়। তখন দরবেশ ও সুলতানদের মধ্যকার পার্থক্য উবে যাবে। সব ধরনের প্রতারণাই তখন প্রকাশ্যে এসে যাবে। এই গাজা উপত্যকাই সবার মুখোশ খুলে দেবে।
অবশ্য এসব দরবেশের দল তখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পক্ষে দলীলবাজিও শুরু করতে পারে। আমাদের মতো অজ্ঞ ও আবেগপ্রবণরা যখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে ইকবাল ও কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করবে, তখন এরাই ইকবালের বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে যাবে এবং তাকে চরমপন্থীদের সহযোগী হিসেবে আখ্যায়িত করবে।
এই কথিত বুদ্ধিজীবী ও দরবেশরা নিজেদের আলোচনায় রসমে শাব্বিরি (বাস্তব জীবনের সংগ্রামে অংশগ্রহণ এবং সমাজের উন্নতি সাধন) নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু কারো কীর্তিতে যখন রসমে শাব্বিরির ঝলক প্রকাশ পায়, তখন তারা ওই ব্যক্তিত্বকে অপছন্দ করে এবং চরমপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে।
আজ গোটা বিশ্ব যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে যুগের হিটলার ও শতাব্দির কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও জঙ্গী বলে আখ্যায়িত করছে, তখন আমাদের দেশের এসব স্ব-ঘোষিত দরবেশরা হামাসের বিরুদ্ধে ঘৃণা উৎপাদন করে বেড়াচ্ছে। এরা মিসরের শারম আশ শায়খ এলাকায় ইসরাইলের সাথে হামাসের সন্ধি চুক্তির পর ছড়ানো শুরু করেছে যে এখন হামাসও তো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে রাজি হয়েছে। তাহলে পাকিস্তানে বসে ইসরাইলের বিরোধিতার কী অর্থ থাকতে পারে? আমরা যারা অজ্ঞ ও আবেগপ্রবণ, আমরা বরাবরই সতর্ক করে এসেছি যে হামাসের হাতে বন্দী ইসরাইলিদের মুক্তির পরই আবার গাজায় হামলা শুরু হবে। এখন ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তির পর যখন প্রতিদিনই যখন যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ইসরাইল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকারও নিন্দা জানাচ্ছে।
আরেকটি কষ্টের কথা হলো- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প -যাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বারবার নির্বাচিত করেছে পাকিস্তান- সম্প্রতি পাকিস্তানের শত্রু ভারতের সাথে ১০ বছরের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পন্ন করেছে। আমাদের সরকার প্রতিদিনই বিবৃতি দিচ্ছে যে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানে প্রক্সিদের মাধ্যমে ভারত উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে এবং আফগান তালেবানকেও তারা ভারতের সহযোগী আখ্যা দিচ্ছে, তাহলে ট্রাম্প এই প্রতিরক্ষা চুক্তির পর কিভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে পারে?
এটি ঠিক যে ট্রাম্পের বক্তব্যে বারবার উল্লেখিত হয়েছে, পাকিস্তানের হাতে ভারতের সাতটি যুদ্ধ বিমান ধ্বংস হয়েছে এবং তিনি নরেন্দ্র মোদিকেও বার কয়েক অপমান করেছেন, কিন্তু ট্রাম্প এই সবকিছুই নিজের স্বার্থের জন্য করেছেন। ট্রাম্প চান, ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করুক এবং মার্কিন পরিকল্পনা অনুযায়ী চীনের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করুক। ভারতের মতো পাকিস্তানকেও ট্রাম্প নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চান। ট্রাম্প সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন, যেন ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের সম্পর্কে ভালোভাবে ফাটল ধরাতে পারেন। একইসাথে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য তিনি পাকিস্তানকে আবরাহাম চুক্তিতে অন্তর্ভুক্তও করতে চান।
ট্রাম্প ফিলিস্তিনি ইস্যু সমাধানের আগেই পাকিস্তান ও ইসরাইলের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চান। এটি সম্ভব হলে কাশ্মিরেও গাজার মতো একটি নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাবনা পেশ করবেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তান ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মাঝে করমর্দন করাতে চান। যেন নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ভারতও ট্রাম্পের নাম প্রস্তাব করে। এরপরে কথিত এসব দরবেশের দল মাজায় গামছা বেঁধে ট্রাম্পের সমর্থনে নামবেন।
আমরা এখনো বিশ্বাস করি যে যতদিন ফিলিস্তিনি ইস্যুর সমাধান না হবে এবং বাইতুল মাকদিস ইহুদিদের গ্রাস থেকে মুক্ত না হবে, পাকিস্তান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে যেতে পারে না এবং হামাসকে নিরস্ত্রকরণের উদ্দেশে গাজায় নিজেদের সেনাও পাঠাবে না।
ইসরাইলের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। কারণ, হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের অপর নাম ইসরাইল। তারই এক ছেলের নাম এহুদা। সেখান থেকেই ইহুদিদের গোড়াপত্তন। সুতরাং আমরা ইসরাইলের বিরোধী নই। বরং আমরা হলাম ফিলিস্তিনিদের উপর চেপে বসা জায়নিজমের বিরোধী।
আমরা নিজেদেরকে এমন সান্ত্বনাও দিয়ে রেখেছি যে যতদিন কাশ্মির সমস্যার সমাধান না হবে, ততদিন পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খুশি করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে করমর্দন করবে না। এক্ষেত্রে কথিত বুদ্ধিজীবীদের কোনো কৌশলই কাজে আসবে না।
মনে রাখবেন, প্রকৃত দরবেশদের মাথায় লম্বা চুল থাকে ঠিক। কিন্তু বর্তমান নামধারি দরবেশরাও ওই বেশভূষা গ্রহণ করে থাকে।
লাহোরের এক মাওলানা তো কয়েক বছর আগে ইসরাইলে ঘোষণা দিয়ে সফর করে এসেছে। এরপরও তিনি এখনো মাওলানা হিসেবেই গণ্য হয়ে আসছেন। এমন কিছু নামধারী মাওলানাকে হয়তো সামনে দিনে দেখা যাবে, যারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করবে। আমরা আবেগপ্রবণরা তখনও এসবের প্রতিবাদ করবো। তখন হয়তো আমাদেরকেও গাদ্দার আখ্যায়িত করা হবে। কিন্তু আমরা এতে ঘাবড়ে যাব না। বরং এমন গাদ্দারির উপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গর্ব করতে থাকব।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩ নভেম্বর ২০২৫ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর করেছেন আবু সাঈদ
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট



