গাজায় গণহত্যাকারী ইসরাইলকে ইউরোভিশন মঞ্চে জায়গা দেয়ার প্রতিবাদে এই সঙ্গীত প্রতিযোগিতা বর্জনকারী দেশের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
ইউরোভিশন ২০২৬-এ ইসরাইলের প্রতিনিধি অংশ নেয়ার অনুমতি পাওয়ার পর ইতোমধ্যে আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও স্লোভেনিয়া এই প্রতিযোগিতা বয়কট করেছে।
সর্বশেষ এই তালিকায় যোগ হয়েছে আইসল্যান্ড। দেশটির জাতীয় রেডিও-টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, তারা ২০২৬ সালের ইউরোভিশনে অংশ নেবে না।
ইউরোভিশন সঙ্গীত প্রতিযোগিতা বিশ্বের অন্যতম বড় সঙ্গীত উৎসব। ১৯৫৬ সাল থেকে এটি প্রতি বছর ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন আয়োজন করে। মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে শুরু হলেও সময়ের সাথে সাথে এটি একটি বিশ্বব্যাপী সঙ্গীত উৎসবে পরিণত হয়েছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো ইউরোপের বাইরে থাকা দেশও এতে অংশগ্রহণ করে। ইউরোভিশনের গুরুত্ব শুধুমাত্র বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি দেশগুলোর সংস্কৃতি, ভাষা ও সঙ্গীতের পরিচয় প্রদর্শনের একটি মাধ্যম।
ইসরাইলি অংশগ্রহণের প্রতিবাদে ক্রমবর্ধমান দেশগুলোর ইউরোভিশন বর্জনকে সাম্প্রতিক ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর একটি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পদক্ষেপ কেবল প্রতিযোগিতার শিল্পী ও বিনোদন দিককে প্রভাবিত করেনি। বরং এটি রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রতিবাদ প্রকাশের একটি মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
বর্জনের কারণ
প্রথম কারণ : গাজায় মানবিক সঙ্কট ও অসংখ্য সাধারণ মানুষের মৃত্যু। অনেক দেশ ও গণমাধ্যম মনে করে, ইসরাইলকে ইউরোভিশনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া মানবিক নীতি ও বিশ্বমানবিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করা। উদাহরণস্বরূপ, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও স্লোভেনিয়ার জাতীয় মিডিয়াগুলো জানিয়েছে, যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরাইলি অংশগ্রহণের মাঝে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এসব দেশ জোর দিয়ে বলেছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের মর্যাদা ও বেঁচে থাকার অধিকারের মতো মূল্যবোধগুলো ‘ইউরোপীয় ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন’র রাজনীতির বলি হতে পারে না।
দ্বিতীয় কারণটি ইসরাইলের ইউরোভিশনের ভোটদান প্রক্রিয়া ও প্রচারণায় প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সন্দেহের সাথে সম্পর্কিত। ইসরাইলি শাসনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ্যস্থির প্রচারণা ও গণমাধ্যম ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতার জনভোটের ফল নিজেদের অনুকূলে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে বলে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি অনেক দেশের প্রতিযোগিতার নিরপেক্ষতা নিয়ে আস্থা নষ্ট করেছে এবং কিছু মিডিয়া ইউরোভিশনের নিরপেক্ষতার উপর আর ভরসা করতে পারছে না।
বর্জনের প্রভাব
প্রথম প্রভাব : ইউরোভিশনের গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদায় হ্রাস। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই প্রতিযোগিতা এখন নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি। আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, স্লোভেনিয়া এবং আইসল্যান্ডের মতো দেশের বেরিয়ে আসা দেখাচ্ছে, ইউরোপের সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় নৈতিকতা বিনোদনের জন্য উৎসর্গ করতে রাজি নয়। এটি বিশ্বব্যাপী দর্শকসংখ্যা ও বিজ্ঞাপন এবং স্পন্সরদের আয় কমাতে পারে।
দ্বিতীয় প্রভাব : ইউরোপে রাজনৈতিক বিভাজন তীব্র হবে। কিছু দেশ যেমন জার্মানি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি ইসরাইলকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেয়া হয়, তারা ইউরোভিশন বর্জন করবে। এটি ইউরোপে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দু’টি বিপরীতমুখী ধারা সৃষ্টি করছে। এর ফলে ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের সংহতি দুর্বল হতে পারে এবং এর কাঠামো ও নিয়মাবলীতে পুনর্বিবেচনা হতে পারে।
তৃতীয় প্রভাব : সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব। ইউরোভিশন বয়কট একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে বৈশ্বিক জনমতের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাচ্ছে। এই বার্তাকে এভাবে বলা যায়, শিল্প ও সংস্কৃতি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বিশেষ করে যখন স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন আসে। এই পদক্ষেপ অতীত দশকগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বয়কটের মতো কাজ করতে পারে এবং ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো বিচ্ছিন্ন করে তুলতে পারে।
ইসরাইলি অংশগ্রহণের প্রতিবাদে ইউরোভিশন বর্জনকারী দেশের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে সংস্কৃতি ও রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই বর্জন কেবল প্রতিযোগিতার নৈতিকতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে না, বরং এটি ইসরাইলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও নৈতিক চাপের একটি মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ইউরোভিশন কেবল একটি ইউরোপীয় সঙ্গীত উৎসব না থেকে, ইসরাইল-সমর্থক ও বিরোধী দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও নৈতিক সংঘর্ষের মঞ্চে রূপান্তরিত হবে এবং এর ভবিষ্যৎ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে।
সূত্র : পার্সটুডে



