ইউরোপে নতুন প্রতিরক্ষা জোট

তুরস্ক-ব্রিটেন সম্পর্কের নতুন সমীকরণ

সাম্প্রতিক সামরিক চুক্তি, বাড়তে থাকা বাণিজ্য এবং ন্যাটোর প্রতিরক্ষা অক্ষকে শক্তিশালী করার অভিন্ন লক্ষ্য- সব মিলিয়ে আঙ্কারা-লন্ডনের সম্পর্ক ইউরোপের কৌশলগত ভারসাম্যে নতুন সমীকরণ তৈরি করছে।

মোহাম্মদ ইব্রাহীম

কৃষ্ণ সাগর, ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থানকারী তুরস্ক-ব্রিটিশ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ২০২৫-এর দৃষ্টিতে যুক্তরাজ্যের জন্য এক অপরিহার্য নিরাপত্তা সঙ্গী।

সাম্প্রতিক সামরিক চুক্তি, বাড়তে থাকা বাণিজ্য এবং ন্যাটোর প্রতিরক্ষা অক্ষকে শক্তিশালী করার অভিন্ন লক্ষ্য- সব মিলিয়ে আঙ্কারা-লন্ডনের সম্পর্ক ইউরোপের কৌশলগত ভারসাম্যে নতুন সমীকরণ তৈরি করছে।

লন্ডনের ৩-সি কৌশল : সংঘাত, প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা

২০২৫ সালের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘রাশিয়ার আগ্রাসন আমাদের মহাদেশকে হুমকির মুখে ফেলছে’ এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘স্বৈরশাসক’ আখ্যা দিয়েছেন।

তবুও এই কৌশলপত্রে শুধু সংঘাত নয়, বরং সহযোগিতামূলক লক্ষ্যও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে- যা যুক্তরাজ্য ও তুর্কির বিদ্যমান ইতিবাচক সম্পর্ককে আরও গভীর করার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করছে।

লন্ডন একদিকে নিজের সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বাড়াতে চাইছে, অন্যদিকে বলছে- সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর আসল শক্তি নিহিত অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়ার মধ্যে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি পরস্পরবিরোধী?-লেখার শেষে এর উত্তর পাওয়া যাবে।

টাইফুন যুদ্ধবিমান : কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রতীক

ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামির আঙ্কারা সফরের আগেই ঘোষণা এসেছিল-তুরস্কে ইউরোফাইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান রপ্তানির চুক্তি হচ্ছে।

আঙ্কারায় আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা শিল্প মেলায় উভয় দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এই সমঝোতা স্বাক্ষর করেন।

যুক্তরাজ্যের দাবি-এটি শুধু ন্যাটোর যৌথ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াবে না, বরং উভয় দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের বহু বছরের সহযোগিতাকে আরও মজবুত করবে।

এই টাইফুন প্রকল্প যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০ হাজার চাকরি সরাসরি বজায় রাখছে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতে বর্তমানে প্রায় এক লাখ কর্মী কাজ করছেন এবং ৩,৫০০ কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে।

প্রতিরক্ষা ছাড়াও বাণিজ্যে উত্থান

প্রতিরক্ষার বাইরেও দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক সমানতালে এগোচ্ছে। ২০২৪ সালে মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮ বিলিয়ন পাউন্ড (৩৭.৫৭ বিলিয়ন ডলার), যার মধ্যে তুরস্কের রফতানি ১৫.২৯ বিলিয়ন ডলার।

প্রায় ভারসাম্যপূর্ণ আমদানি-রফতানি প্রমাণ করছে তুরস্ক আর ‘সস্তা যন্ত্রাংশ’ রফতানিকারক নয়; বরং এটি এখন বিশ্বমানের উচ্চমানের চূড়ান্ত পণ্য উৎপাদক হিসেবে স্বীকৃত।

২০২৪ সালে তুরস্ক প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ খাতে ৭.১৫৪ বিলিয়ন ডলার রফতানি করেছে-যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২৯% বেশি। অনুমান করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই যুক্তরাজ্যও তুরস্কের উচ্চ প্রযুক্তির প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বড় ক্রেতায় পরিণত হতে পারে।

ইউরোপের কৌশলগত সমীকরণে প্রভাব

প্রশ্ন হচ্ছে-এটি কি কেবল কূটনৈতিক প্রদর্শন, নাকি সত্যিকার অর্থে ইউরোপের প্রতিরক্ষা নীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত?

বিশ্লেষকরা বলছেন, আঙ্কারা-লন্ডনের ঘনিষ্ঠতা ইউরোপের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাঠামোকে নতুন আকার দিতে পারে। এমনকি তুরস্কের বহু প্রতীক্ষিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যপদও এ প্রেক্ষাপটে নতুন গতি পেতে পারে।

স্বাধীনতা বনাম সহযোগিতা

লেখার শুরুতে উত্থাপিত প্রশ্ন-সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো কি স্বাধীনতা বজায় রেখে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে পারে? উত্তর হলো-হ্যাঁ, যদি তারা সমমর্যাদায় এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে এগোয়।

ইউরোপের বাইরে শক্তিশালী যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের ভেতরে সম্ভাব্য শক্তিশালী তুরস্ক, তার উপর ঘনিষ্ঠ লন্ডন-আঙ্কারা সম্পর্ক হয়তো হতে পারে ভবিষ্যতের সবচেয়ে কার্যকর রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা অক্ষ।

আনাদোলু এজেন্সি থেকে অনুদিত।