১.৮ টন স্বর্ণ দিয়ে ইরানি ড্রোন কিনছে রাশিয়া

গবেষকরা মনে করছেন, মার্কিন ডলার ব্যবহার না করে স্বর্ণ লেনদেনের মাধ্যমে রাশিয়া কার্যত ইরানের ওপর আরোপিত একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাচ্ছে।

সৈয়দ মূসা রেজা
শাহেদ ড্রোন
শাহেদ ড্রোন |সংগৃহীত

ইরান-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোড়ন তুলেছে একটি মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ইরানের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হামশাহরি অনলাইনের প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক সি৪এডিএসের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন টাইমসের দাবি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে শাহেদ-১৩৬ ড্রোন কিনতে ১.৮ টন স্বর্ণ দিয়েছে, যার মূল্য আনুমানিক ১০৪ মিলিয়ন ডলার।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, লেনদেনটি ২০২৩ সালের মার্চ মাসের। এ বিষয়ে একটি চুক্তিও হয়েছে। চুক্তিতে প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ধরা হয়েছিল ৫৮.৩২ ডলার। কয়েক সপ্তাহ পর আরো দুই টনের বেশি স্বর্ণ পাঠানোর জন্য আরেকটি চুক্তি হয়। তবে সে মোতাবেক ইরানে স্বর্ণ পাঠানো হয়েছে কি-না সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গবেষকরা মনে করছেন, মার্কিন ডলার ব্যবহার না করে স্বর্ণ লেনদেনের মাধ্যমে রাশিয়া কার্যত ইরানের ওপর আরোপিত একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাচ্ছে।

সি৪এডিএসের প্রতিবেদন দাবি করছে, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে এই ড্রোন সহযোগিতা শুধু সামরিক সুবিধা নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কেও গভীরতা এনেছে। শাহেদ ড্রোন নির্মাণকারী ইরানের সাহরা থান্ডার নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রুশ সেনাবাহিনীতে ড্রোন সরবরাহ করছে।

এ সহযোগিতায় রাশিয়ার আলবুগা জেএসসি নামের প্রতিষ্ঠানও জড়িত। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় রাশিয়া প্রথমদিকে ইরান থেকে ড্রোন আমদানি করলেও পরে স্থানীয়ভাবে ‘গ্রান-২’ নামে এ ড্রোনের সংস্করণ তৈরি করতে সক্ষম হয়। এখন রাশিয়া নিজ দেশে ড্রোন উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশী আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রাশিয়া স্থানীয়ভাবে দীর্ঘপাল্লার আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং ব্যয়বহুল ড্রোনগুলোর নকশায় পরিবর্তন এনে নিজের প্রয়োজনমাফিক ড্রোন তৈরি করছে। এভাবে তারা ইরানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আরো আত্মনির্ভর হয়ে উঠছে।

এ উৎপাদন বাড়ানোর মূলকেন্দ্র রাশিয়ার তাতারস্তান অঞ্চল। এখান থেকেই বিপুল সংখ্যক ড্রোন সরবরাহ করে ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ জোরদার করছে মস্কো।

সি৪এডিএসের দাবি, আলাবুগা ও সাহরা থান্ডার- এ দুই প্রতিষ্ঠানই নিজ নিজ দেশের সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ। তবে তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম চালায়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আমিরাত ১০০ শতাংশ বিদেশী মালিকানা, কর-মুক্ত সুবিধা, মুনাফা ফেরত নেয়ার স্বাধীনতা এবং শেয়ারহোল্ডার দায়সীমা নির্ধারণের মতো বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে এ ধরনের নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে সাহরা থান্ডারকে ইরানের সামরিক বাহিনীর মুখোশ হিসেবে চিহ্নিত করে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সি৪এডিএস তাদের প্রতিবেদনে বলছে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। বরং এতে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতা আরো গভীর হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত ইরান ও রাশিয়ার ড্রোন উৎপাদনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং এই দুই মার্কিনবিরোধী শক্তি আরো কাছাকাছি এসেছে। ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে বা বজায় রাখতে চাইলে এখনই এ ধরনের মার্কিন বিরোধী কৌশলগত জোটগুলোর অবস্থান বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে।

পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০২৫ সালে ইউক্রেনে ড্রোন আক্রমণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। মে মাসে কিয়েভ শহরে প্রতিদিন গড়ে ১০০টিরও বেশি ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। সপ্তাহান্তে একদিনে ৩৫০টির বেশি ড্রোন হামলা চালায় রাশিয়া, যেটি যুদ্ধ শুরুর পর থেকে একদিনে সর্বোচ্চ ড্রোন আক্রমণ।

এমন পরিস্থিতিতে আবারো সতর্কবার্তা দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া প্রতিদিন ৩০০টির বেশি ড্রোন তৈরি করতে সক্ষম, অথচ ইউক্রেন প্রতিদিন তৈরি করতে পারে মাত্র ১০০টি। আমাদের মিত্রদের উচিত প্রতিরক্ষা ও দীর্ঘপাল্লার প্রতিশোধের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়ানো।’

এদিকে, যুদ্ধের ময়দানে আধুনিক প্রযুক্তির ছায়া যত গভীর হচ্ছে ততই বদলে যাচ্ছে যুদ্ধের ধরন। একসময় যেখানে আকাশ দখলে রাখতে প্রয়োজন হতো দামি ফাইটার জেট, আজ সেখানে উঁকি দিচ্ছে সস্তা, স্বনির্ভর, আত্মঘাতী ড্রোন। এ বিপ্লবের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে ইরানীয় ড্রোন শাহেদ-১৩৬, যাকে কেউ বলেন ‘ক্যামিকাজে বা আত্মঘাতী ড্রোন’। কেউ বা ওড়ার সময় আওয়াজের কারণে ডাকেন ‘মপেড ড্রোন’ নামে। শাহেদ-১৩৬ হলো একটি কম খরুচে, নিম্ন প্রযুক্তির ভাসমান বিস্ফোরক বা লো-টেক, লো-কস্ট ‘লোইটারিং মিউনিশন’ ড্রোন।

আত্মঘাতী এ চালকহীন আকাশ অস্ত্রযান লক্ষ্যবস্তুর ওপর নিজের বিস্ফোরণ করেই কাজ শেষ করে। শাহেদের নকশা ও ব্যবহার পদ্ধতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন এটি অল্প খরচে বড়মাপের ক্ষতি করতে পারে এবং প্রয়োজনে দলবদ্ধভাবে অর্থাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে একসাথে আক্রমণ চালাতে পারে। সামরিক পরিভাষায় এ ধরনের হামলাকে সোয়ার্ম অ্যাটাক বলা হয়।

শাহেদ-১৩৬-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর কম খরচে নির্মাণ এবং ঝাঁকে ঝাঁকে আঘাত হানার ক্ষমতা। এককভাবে খুব জটিল প্রযুক্তি নয়, কিন্তু স্বল্পসংখ্যক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকলে বা সময় মতো বাধা না দিলে শাহেদ সহজেই শত্রুর বড় ক্ষতি করতে পারে।

ইউক্রেনে দেখা গেছে, ১০টি শাহেদ ড্রোন ধ্বংস করতে পশ্চিমা দেশগুলোকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিটি শাহেদের দাম পড়ছে মাত্র ২০ থেকে ৫০ গাজার মার্কিন ডলারের মধ্যে।