কলকাতায় জীবনেও এমন বৃষ্টি দেখিনি : মেয়র

শহরবাসীকে রাস্তায় না বের হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ওয়ার্ক ফর্ম হোম চালু করার অনুরোধ জানিয়েছেন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
কলকাতায় রেকর্ড বৃষ্টিপাত
কলকাতায় রেকর্ড বৃষ্টিপাত |সংগৃহীত

টানা বৃষ্টির জেরে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কলকাতা। সোমবার রাত থেকে ভোর পর্যন্ত টানা বৃষ্টিপাতের কারণে জলমগ্ন কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকা।

আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের জেরে এই বৃষ্টিপাত। রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত গড়ে ২৪৭ দশমিক ৭ মি.মি. বৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও এই বৃষ্টির পরিমাণ আরো বেশি। যার জেরে কোথাও হাঁটু পর্যন্ত পানি জমেছে কোথাও বা কোমর পর্যন্ত।

এদিকে জমা পানিতে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে কমপক্ষে নয়জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, ‘আমি এমন বৃষ্টি কখনো দেখিনি। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। পূজার আগে এতগুলো প্রাণ চলে গেল! আমি শোকস্তব্ধ।’

শহর ও শহরতলির কোথাও হাঁটু সমান পানি জমেছে, কোথাওবা তার বেশি। বহু বাড়িতে ইতোমধ্যে পানি ঢুকেছে, ব্যাহত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বহু ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। রেললাইনে পানি জমার কারণে লোকাল ও দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। একাধিক শাখায় মেট্রোরেলও বন্ধের জেরে প্রাভবিত হয়েছে যাত্রী পরিষেবা। দুর্যোগের জেরে বহু বিমান বাতিল করা হয়েছে।

বিপর্যয়ের কারণে রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোতে পূজার ছুটি ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বেসরকারি স্কুলগুলোতে আগামী দুই দিন ছুটি দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

এদিকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বাতিল করে দেয়া হয়েছে।

দুর্গাপূজার আগে উৎসবমুখর কলকাতায় এই বিপর্যয়ের ছাপ স্পষ্ট। একাধিক পূজা প্যান্ডেলে পানি জমেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মণ্ডপসজ্জাও, যার জেরে উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন মৃৎশিল্পী, পূজার আয়োজক এবং ব্যবসায়ীরা।

জলমগ্ন কলকাতার পরিস্থিতি
আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, বৃষ্টির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা ও শহরতলিতে। স্বল্প প্রভাব পড়েছে প্রভাব পড়েছে সংলগ্ন হাওড়া-হুগলিতে।

পানি নিষ্কাশন পাম্পিং স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার রাত থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত বেলগাছিয়াতে ১৮৪ মিলিমিটার, উল্টোডাঙায় ২২১, গড়িয়ার কাছে কামডহরিতে- ৩৩০ মিলিমিটার এবং ঠনঠনিয়ায় ১৯৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

গত কয়েক দশকে এই পরিমাণ বৃষ্টি হয়নি বলেই জানানো হয়েছে। এর জেরে কার্যত পানির তলায় রয়েছে কলকাতার বহু অঞ্চল। পৌরসভার তরফ থেকে জানানো হয়েছে, আর নতুনভাবে বৃষ্টি না হলে জমা পানি নামতে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগবে।

এদিকে, আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবারও বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টির আভাস রয়েছে। দুপুর থেকে উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার একাধিক অঞ্চলে স্বল্প বৃষ্টিপাত হয়েছে।

কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘আমি কলকাতায় জন্মেছি কিন্তু এমন বৃষ্টি দেখিনি। ভয়াবহ বৃষ্টি।’

উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে একটা পুরানো বাড়ি মঙ্গলবার ভেঙে পড়ে। তবে এই ঘটনায় কেউ আহত হননি।

বিপর্যস্ত জনজীবন
টানা বৃষ্টির জেরে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে নিত্যযাত্রীরা ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়েছেন। যানসঙ্কট এবং যানজট দুই সমস্যার সাথেই লড়তে হয়েছে যাত্রীদের।

উত্তরপাড়ার বাসিন্দা রাহুল শঙ্কর বলেছেন, ‘সকাল থেকে ব্যাপক ভোগান্তি হয়েছে। মেট্রো চলাচল করছে না। রেল লাইনে পানি জমার কারণে ট্রেন পরিষেবাও ব্যহত হয়েছে। বাসে ব্যাপক ভিড়।’ তার গন্তব্য ছিল দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়া।

‘কোনো মতে যাদবপুর পর্যন্ত পৌঁছে কোনো যানবাহন পাইনি। বাধ্য হয়ে রাস্তায় জমা পানি ঠেলে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার যেতে হয়েছে,’ বলেছেন তিনি।

অন্যদিকে, গড়িয়া থেকে সল্টলেকের অফিসে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে নিত্যযাত্রী সৌমী পালকে। তার কথায়, ‘রাস্তায় পানি থৈথৈ করছে। বাসের সংখ্যা কম, অ্যাপ ক্যাবও নেই। রাস্তায় ব্যাপক যানজট। দীর্ঘক্ষণ ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকার পর সেক্টর ফাইভ-এ পৌঁছে দেখি হাঁটু অব্দি জল।’

কসবার স্বপ্না মিত্র জানিয়েছেন, তার পাড়া জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। তার কথায়, ‘টানা বৃষ্টির জেরে কোথাও কোথাও রাস্তায় কোমর পর্যন্ত পানি জমেছে। বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। আসবাবপত্র ভাসছে। নাজেহাল অবস্থা।’

একই চিত্র উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন এলাকায়।

দমদমেও একই পরিস্থিতি। দমদমের বাসিন্দা মিশুয়া সেন জানিয়েছেন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সঠিক না হওয়ায় বৃষ্টি হলেই জলমগ্ন হয়ে ওঠে তার পাড়া। গত রাতের বৃষ্টির পর সেই একই চিত্র দেখা গেছে।

দমদমের আরেক বাসিন্দা সুদীপ্ত ভৌমিক বলেছেন, ‘চারিদিকে পানি। কেউ অসুস্থ হলে তাকে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে সেই পরিস্থিতি নেই।’

এদিকে, কলকাতার একাধিক সরকারি হাসপাতাল চত্বরে ব্যাপক পানি জমেছে।

আরজি কর হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর আত্মীয় জানিয়েছেন, জমা পানির জেরে তাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তার কথায়, ‘অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর পর স্ট্রেচারে করে যে রোগীদের আনা হবে সেই পরিস্থিতিও নেই।’

একই চিত্র এসএসকেএমসহ কলকাতার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে।

পূজার আগে উদ্বেগ

দুর্গা পূজার আগে ব্যাপক বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের একাধিক প্যান্ডেল। গড়িয়ার এক দুর্গাপূজা কমিটির সদস্য জানিয়েছেন, মণ্ডপে পর্যন্ত পানি ঢুকে গিয়েছে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মণ্ডপসজ্জা। চিন্তায় রয়েছেন পূজার উদ্যোক্তা, মৃৎশিল্পী এবং ব্যবসায়ীরা।

গড়িয়ার এক পূজা কমিটির সদস্য জানিয়েছেন, মণ্ডপের ভেতরে পানি ঢুকে গিয়েছে। তার কথায়, ‘আগামীকাল প্রতিমা মণ্ডপে আনার কথা ছিল। তারপর আরো কিছু মণ্ডপসজ্জার কাজ বাকি রয়েছে। এখন যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কী হবে বুঝতে পারছি না।’

দক্ষিণ ২৪ পরগণার রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভার অন্তর্গত অঞ্চলের দুর্গাপূজা কমিটির সদস্য অশোক বিশ্বকর্মা বলেছেন, ‘কয়েক মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মণ্ডপ সাজানো হয়েছিল। সবই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।’

ভিড় এড়াতে মহালয়ার পর থেকেই কেউ কেউ ঠাকুর দেখা শুরু করেছিলেন। তাদেরই একজন চিরন্তন পাল। এই কলেজ শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘আমার বাড়ি কৃষ্ণনগরে। বন্ধুরা ঠিক করেছিলাম কলকাতার বড় ঠাকুরগুলো দেখব। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়।’

কেন এই পরিস্থিতি
আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, নিম্নচাপের জেরে সোমবার গভীর রাত থেকেই শহরজুড়ে বৃষ্টি শুরু হয়। কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে পানি জমতে থাকে।

কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, পৌরসভার তরফ থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি নামানোর ব্যবস্থা করা হলেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

হাকিম বলেছেন, ‘আমরা পৌরসভা থেকে সব পানি ক্যানালে ফেলছি। কিন্তু পানি আবার ব্যাক ফ্লো করছে। আমরা লক গেটগুলো খুলে দিয়েছিলাম কিন্তু সেখান থেকেও ব্যাক ফ্লো হয়ে চলে আসছে।’

তিনি জানিয়েছেন, গঙ্গায় জোয়ার আসার কথা রয়েছে। তারপর নদীতে ওই পানি ফেলা যেতে পারে বলে তার অনুমান। পাশাপাশি কলকাতার পাম্পিং স্টেশনগুলোর পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা সীমিত।

মেয়র জানিয়েছেন, কলকাতার পাম্পিং স্টেশনগুলোতে পাইপ দিয়ে ঘণ্টায় ২০ মিলিমিটার করে পানি যেতে পারে। সেখানে ৩০০ মিলিমিটার পানি বেরোতে অনেকটাই সময় লাগবে। উপরন্তু এখন নদী এবং খালও পানিতে ভরা। তাই এই জলমগ্ন পরিস্থিতি।

ফুটপাতবাসীদের জন্য স্থানীয় স্কুলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র।

কলকাতার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। তিনি বলেছেন, ‘কাল রাত থেকে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। আবার গঙ্গায় হাইটাইড এসেছে। বৃষ্টির পানি যে যাবে সেই পরিস্থিতি নেই।’

পরিস্থিতির জন্য দামোদর ভ্যালি করপোরেশনকেই দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার কথায়, ‘দীর্ঘদিন ড্রেজিং করা হয় না, যার ফলে এই অবস্থা। ডিভিসি পানি ছেড়ে দিয়েছে। কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেব। ড্রেজিংয়ের দায়িত্ব কেন্দ্র সরকারের। কিন্তু বারবার বলেও কিছু হয়নি।’

জমা পানিতে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনার জন্য ‘ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই করপোরেশন’ (সিইএসসি)-কেই দায়ী করে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, ‘আমি সিইএসসিকে বলেছি বিদ্যুতের কাজ করার পর তাদের কর্মীরা তার খোলা রাখে। সেই কারণেই এই বিপর্যয়।’

মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সিইএসসি কর্তৃপক্ষকে নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ও চাকরির ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।

এদিকে কলকাতার পরিস্থিতির জন্য শাসকদলকে নিশানা করেছে বিরোধীদলগুলো। কলকাতার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কেন উন্নতি হয়নি সেই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিরোধী নেতারা।

এর জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘পানিটা বের করবে কোথায়? সব তো ডুবে আছে।’ তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে প্রশাসন তৎপরতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে।

শহরবাসীকে রাস্তায় না বের হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ওয়ার্ক ফর্ম হোম চালু করার অনুরোধ জানিয়েছেন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। সূত্র : বিবিসি