দাফনের মতো লোকও নেই পাকিস্তানের একটি গ্রামে

বন্যায় পুরো বাড়ি ভেসে যাওয়ার সময় আব্দুল সামাদের পরিবারের পাঁচজন সদস্য ছিলেন ভেতরে। তারা এখনো নিখোঁজ। কেউ তাদের খবর জানে না।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায় বন্যা ও বৃষ্টিতে মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায় বন্যা ও বৃষ্টিতে মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে |বিবিসি

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বেশন্ত্রি গ্রামে আকস্মিক বন্যার খবর পেয়ে মসজিদের স্থানীয় ইমাম মাওলানা আব্দুল সামাদ অন্য গ্রামবাসীর মতো তার পরিবারকেও দ্রুত বাড়ি খালি করার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পর যখন তিনি বাড়ি ফিরে আসেন, তখন তিনি দেখতে পান আকস্মিক এই বন্যার পানির তোড়ে তার বাড়িসহ অনেকের বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

বেশন্ত্রি গ্রামটি বুনের জেলার পীর বাবা সাহেব উপজেলায় পড়েছে।

পাকিস্তানের সরকারি হিসাবে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে গত ৪৮ ঘণ্টায় বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। সেখানকার প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (পিডিএমএ) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৩০৭ জন নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়েছেন।

পিডিএমএ-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনের অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ২৭৯ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী এবং ১৩ জন শিশু রয়েছে। আহতদের মধ্যে ১৭ জন পুরুষ, চারজন নারী এবং দু’জন শিশু রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভারী বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক বন্যার কারণে এখন পর্যন্ত মোট ৭৪টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩টি আংশিক এবং ১১টি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।’

এমন দুর্ঘটনা প্রদেশের বিভিন্ন জেলা যেমন সোয়াত, বুনের, বাজাউর, তোরঘর, মানসেহরা, শাঙলা এবং বটগ্রাম।

বন্যায় পুরো বাড়ি ভেসে যাওয়ার সময় আব্দুল সামাদের পরিবারের পাঁচজন সদস্য ছিলেন ভেতরে। তারা এখনো নিখোঁজ। কেউ তাদের খবর জানে না। সেই সময় পীর বাবা সাহেব উপজেলার সাবেক কর্মকর্তা বা তহসিল নাজিম আশফাক আহমদ ইসলামাবাদে ছিলেন। যখন তিনি তার বাড়ি থেকে খবর পান যে বিশাল বন্যা হানা দিতে পারে, তিনি তখনই তার পরিবারকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিবারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে গেলে কারো কোনো খোঁজ মেলেনি। এমনকি পুরো গ্রামের কাউকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

এই উদ্বেগজনক অবস্থায় তিনি যখন তার গ্রামে পৌঁছান, তখন সর্বত্র কেয়ামতের দৃশ্য দেখা যায়। পুরো গ্রাম ধ্বংসপ্রাপ্ত, বাড়ি-ঘর বিনষ্ট হয়ে গেছে, আহতরা এখানে সেখানে লুটিয়ে পড়ে আছে। তার বাড়িসহ কারো বাড়ি নিরাপদ ছিল না। সর্বত্র ধ্বংস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যারা পানিতে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন তারা গুরুতর আহত।

আশফাক আহমদের বাড়িতে তখন ১৪ জন ছিলেন। তাদের মধ্যে চারজনের লাশ পাওয়া গেছে, বাকি ১০ জন এখনো নিখোঁজ। বন্যার সময় গাছে ওঠার কারণে একটি পরিবারের দুই সদস্য বেঁচে গেছেন, আর তাদের পরিবারের বাকি নয়জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছেন।

‘অগণিত মানুষ এখনো নিখোঁজ‘

প্রদেশেটিতে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত জেলা বুনারের জরুরি উদ্ধারকারী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো বেশন্ত্রি গ্রাম। সেখানে মানুষের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করার জন্য মতো কেউ ছিল না। এসব কাজে পাশের গ্রামের মানুষদের সাহায্যে করতে হয়েছে।

সাহায্যকারীদের মধ্যে ছিলেন বুনেরের ব্যবসায়ী নূর ইসলাম এবং বিদেশ থেকে ছুটিতে নিজ ভিটায় আসা মুহাম্মদ ইসলাম। তারা দুর্গত গ্রামবাসীর সহায়তার এগিয়ে আসেন।

নূর ইসলাম জানান, তিনি দুপুর ১টার দিকে বেশন্ত্রি গ্রামে পৌঁছান। তখন সেখানে একটা বাড়িও অক্ষত ছিল না। সন্ধ্যা নাগাদ আমি আমার বন্ধুবান্ধব এবং স্থানীয় লোকেদের সাথে বেশ কয়েকটি জানাজায় অংশ নিয়েছি। আমার সংখ্যাটিও মনে নেই, যদিও আমি নিজে ছয়টি কবর খননে সাহায্য করেছি। আমি বেলা ১১টায় বন্যার খবর পাই। এর সাথে সাথে এলাকার মসজিদগুলোয় ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়। এরপর আমি অন্যান্য মানুষদের সাথে বেশন্ত্রি গ্রামের দিকে হেঁটে যাই।‘

নূর ইসলাম আরো বলেন, ‘বেশন্ত্রি গ্রামটি পীর বাবা সাহেব সদর উপজেলা থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে, কিন্তু আকস্মিক বন্যার কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সর্বত্র ধ্বংসের চিহ্ন। ফলে ‌আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছাতে দুপুর ১টা বেজে যায়। আমাদের আগেই সেখানে আরো অনেক লোক চলে এসেছিল, যারা ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিল। সেখানকার দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। আমি দেখেছি আহতরা মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। যারা সেখানে পৌঁছেছিল তারা আহতদের তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল, আবার অনেকে ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ উদ্ধার করছিল।‘

নূর ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে বেশন্ত্রি গ্রামের মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল সামাদকে চিনতেন। তিনি বলেন, আব্দুস সামাদ সাহেব আমাকে বলেছেন, যখন বন্যার পানি আসছিল, তখন পানির তোড় খুব একটা বেশি ছিল না। তিনি পরিবারের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন এলাকার অন্যান্য লোকদের মতো তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চলে যান।‘

নূর ইসলাম আরো বলেন, ‘আমি পীর বাবা সাহেব উপজেলার সাবেক কর্মকর্তা বা তহসিল নাজিম পীর বাবা আশফাক আহমেদের পরিবারের সদস্যদের কবর খননে সাহায্য করেছি। দুর্ঘটনার সময় আশফাক আহমেদ ইসলামাবাদে ছিলেন। তার পরিবারের দশজন সদস্য এখনো নিখোঁজ।‘

তিনি বলেন, ‘গ্রামে প্রায় সব বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে এমন বাড়ির সংখ্যা খুব কমই রয়েছে যেখানে পরিবারের কেউ নিখোঁজ নেই। স্পষ্টতই, নিখোঁজদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।‘

বুনারের জরুরি উদ্ধার বিভাগের তথ্য মতে, অনেক মানুষ তাদের পরিবারের সদস্যদের, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু, তাদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। বহু মানুষ এখনো তাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পাচ্ছেন না।

‘এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি‘

উদ্ধারকারী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বুনেরের বেশন্ত্রি গ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় এক হাজার।

মুহাম্মদ ইসলাম জানান, তিনি দুপুর আড়াইটায় সেখানে পৌঁছান। পুরো গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো তখন, যেন এক মৃত্যুপুরী। সেই দৃশ্য ছিল ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী। সেখানকার সব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা লাশ রাখার জন্য উপযুক্ত কোনো জায়গা ছিল না।‘

দুর্গত মানুষদের সাহায্যে শত শত মানুষ এগিয়ে এসেছিল এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই লাশ উদ্ধার ও কবর খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।

মুহাম্মদ ইসলাম আরো জানান, তার এক আত্মীয়ের পরিবারের মধ্যে কেবল দুই শিশু বেঁচে গিয়েছিল। কারণ তারা বন্যার সময় গাছে চড়েছিল। তারা আমাদের বলেছে যে ধ্বংসস্তূপের নিচে ছয়টি লাশ রয়েছে। আমরা সেই মৃতদেহগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুঁজে পাইনি।‘

তিনি বলেন, ‘আমার আরেক বন্ধু, সাহেবজাদা আশফাক আহমেদ, যিনি নিজে ইসলামাবাদে থাকেন। তার পরিবারের ১৩ জন সদস্য রয়েছেন, যাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র চারজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে পরিবারের শিশু এবং নারী সদস্যরা এখনো নিখোঁজ।‘

নূর ইসলাম জানান, তিনি ও তার সহযোগীরা ওই পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ উদ্ধার ও তাদের দাফনের ব্যবস্থা করতে সাহায্য করেছেন।

জরুরি উদ্ধার বিভাগ বা রেসকিউ ১১২২ বুনেরের কর্মকর্তা আব্দুল রহমান জানান, বেশন্ত্রি ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি গ্রামও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের উদ্ধারকারী দল ইতোমধ্যেই দুর্গত অঞ্চলে পৌঁছেছে। পাশাপাশি প্রদেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও উদ্ধারকারী দল আসছে।

‘কিন্তু পরিস্থিতি খুবই সঙ্কটজনক,‘ বলেন আব্দুল রহমান।

‘রাতের অন্ধকারে উদ্ধারকাজে অসুবিধা হচ্ছে। মোবাইল সিগন্যাল খুব দুর্বল এবং বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যার মধ্যে উদ্ধার কাজ চলছে। হাসপাতালে ক্রমাগত লাশ ও আহতদের আনা হচ্ছে এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।‘

পিডিএমএ জানিয়েছে, ভারী বর্ষণ ও বন্যার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো সোয়াত, বুনের, বাজাউর, তোরঘর, মানসেহরা, শাংলা এবং বটগ্রাম।

ভারী বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক বন্যার কারণে সংস্থাটি বাজাউর এবং বটগ্রামকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

পিডিএমএ জানিয়েছে যে বাজাউর এবং বুনের জেলায় ত্রাণ কাজের জন্য হেলিকপ্টারও পাঠানো হয়েছে, যেখানে উদ্ধার অভিযান চলছে।

সম্পদের ক্ষতি

পিডিএমএ জানিয়েছে, ভারী বর্ষণ ও আকস্মিক বন্যায় এখন পর্যন্ত ৪৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি বাড়ি আংশিকভাবে এবং সাতটি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

পিডিএমএ-এর মতে, উদ্ধারকারী দল ও জেলা প্রশাসন একে অপরের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগে রয়েছে এবং পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

খাইবার পখতুনখোয়া প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে সব সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বর্ষণ ও আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর জন্য মোট ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

পিডিএমএ জানিয়েছে, বুনের জেলার জন্য ১৫ কোটি, বাজাউর, বটগ্রাম ও মানসেরা জেলায় যথাক্রমে ১০ কোটি করে এবং সোয়াত জেলায় পাঁচ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

পিডিএমএ বিবৃতি অনুসারে, পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় বন্ধ মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়ক পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থাৎ সড়ক যোগাযোগ পথ পুনঃস্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে সব সম্পদ ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আবহাওয়া বিভাগ ইঙ্গিত দিয়েছে যে চলমান এই ভারী বৃষ্টিপাত ২১ আগস্ট পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে অব্যাহত থাকতে পারে।

পিডিএমএ সমস্ত পর্যটকদের আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।

ক্লাউড বার্স্ট বা মেঘের বিস্ফোরণ কী?

আবহাওয়া বিভাগের সংজ্ঞা অনুসারে, যদি একটি ছোট এলাকায় (এক থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে) এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে এই ঘটনাকে ‘মেঘের বিস্ফোরণ‘ বা মেঘভঙা বৃষ্টি বলা হয়।

কখনো কখনো একই স্থানে একাধিক ‘মেঘের বিস্ফোরণ‘ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে, প্রচুর প্রাণহানি ঘটে, যেমনটি ২০১৩ সালে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে ঘটেছিল।

তবে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রতিটি ঘটনাকে ‘মেঘের বিস্ফোরণ‘ বলা যায় না। এখানে এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে এক ঘণ্টায় মাত্র ১০ সেন্টিমিটার ভারী বৃষ্টিপাত খুব বেশি ক্ষতি করে না।

তবে যদি কাছাকাছি কোনো নদী বা হ্রদ থাকে এবং তা হঠাৎ করে প্রচুর পানিতে ভরে যায়, তাহলে আশেপাশের আবাসিক এলাকায় অনেক ক্ষতি হতে পারে।

সূত্র : বিবিসি