ভারতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় মুসলিমদের ওপর কেন দমন-পীড়ন চলছে

ভারতে গত ১১ বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের নথিভুক্ত ঘটনা ছিল ৬৬৮টি। এক বছরে তা বেড়ে এক হাজার ১৬৫টিতে পৌঁছেছে। এ ধরনের ঘটনা বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে বেশি ঘটেছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
মসজিদের বাইরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ পোস্টার বহন করছে মানুষ
মসজিদের বাইরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ পোস্টার বহন করছে মানুষ |সংগৃহীত

ভারতে গত এক মাস ধরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর বাজার ও বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মুসলিম পুরুষদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় বুলডোজার দিয়ে কিছু বাড়িও গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

গ্রেফতার ব্যক্তিদের কথিত অপরাধের সূত্র একই- পোস্টার, টি-শার্ট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া পোস্টে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর নাম উল্লেখ করে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা। কর্তৃপক্ষের দাবি, এই বাক্যটি ‘আইনশৃঙ্খলার’ জন্য হুমকিস্বরূপ।

এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মুসলিমের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অলাভজনক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর)- এর তথ্য অনুসারে, বিজেপিশাসিত একাধিক রাজ্যে কমপক্ষে ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ভারতে কী ঘটছে?

উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর শহরে ৪ সেপ্টেম্বর মুসলিমরা মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করছিলেন। সে সময় এক মহল্লায় ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা আলোকসজ্জিত একটি বোর্ড লাগানো হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ‘আই লাভ নিউইয়র্ক’ সাইনবোর্ডের অনুকরণ করে এটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় কিছু হিন্দু এর সমালোচনা করেন। প্রাথমিকভাবে তাদের অভিযোগ ছিল, প্রকাশ্য ধর্মীয় উৎসব উদ্‌যাপনে নতুন কোনো উপাদান সংযোজন করা উত্তর প্রদেশের আইনে নিষিদ্ধ। আলোকসজ্জিত বোর্ডটি ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্যবাহী উৎসবে নতুন সংযোজন। কানপুরের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ মুসলিম।

এই অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ দুই ডজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তাদের বিরুদ্ধে আরো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়- ধর্মকে ব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়ানো। অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

কানপুরের ঘটনায় মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা ব্যাপক সমালোচনা করে এবং পুলিশের এমন পদক্ষেপে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা, পশ্চিমে গুজরাট ও মহারাষ্ট্র এবং উত্তরে উত্তরাখণ্ড, জম্মু ও কাশ্মিরসহ অন্যান্য রাজ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। টি-শার্ট থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে কানপুর থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরে, উত্তর প্রদেশের বেরিলিতে ২৬ সেপ্টেম্বর কানপুরের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে স্থানীয় একজন ইমামের ডাকা বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী একদল লোকের সাথে পুলিশের সহিংস সংঘর্ষ হয়। এরপরই পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়ে ইমাম তৌকির রাজা ও তার আত্মীয়স্বজন, সহযোগীসহ ৭৫ জনকে গ্রেফতার করে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মালিকানাধীন কমপক্ষে চারটি ভবন বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়।

India

বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে বাড়ি

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত ভারতীয় মুসলিমদের বাড়িঘর একইভাবে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় সময়ই কর্তৃপক্ষের কোনো নোটিশ বা আদালতের কোনো আদেশ ছাড়াই বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, শাস্তি হিসেবে কারও বাড়ি ভাঙা যাবে না। বাড়ি ভাঙার আগে রাজ্য কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সেই আদেশ অনুসরণ করা হয় না বলে জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখাযুক্ত পোস্ট ও ভিডিওর জন্য বিভিন্ন রাজ্যে আরো কয়েক ডজন মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটও রয়েছে।

এটা কি অবৈধ?

ভারতের সংবিধানে ধর্ম পালনে স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৫ অনুসারে, প্রত্যেক নাগরিক স্বাধীনভাবে তার ধর্ম পালন করতে পারেন। অনুচ্ছেদ ১৯(১)(ক)-এর অধীনেও নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। যা বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে, যদি না এটি সরাসরি সহিংসতা বা বিদ্বেষ উস্কে দেয়।

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখার কারণে পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ‘নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া’ বা ধর্মীয় উত্তেজনা উসকে দেয়ার মতো ধারায় মামলা করা হয়েছে। কিন্তু এই মামলাগুলো করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা ছবি পোস্ট বা টি-শার্ট পরার জন্যে গ্রেফতার হয়েছেন।

অলাভজনক সংস্থা এপিসিআরের জাতীয় সমন্বয়কারী নাদিম খান এই মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি এর আগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমদের মতপ্রকাশের জন্য লক্ষ্যবস্তু করা অথবা তাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা লড়েছেন।

তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ সতর্কতার সাথে আইনি বিধান ব্যবহার করছে। সরাসরি এই বাক্যকে নয়, বরং এটি ব্যবহার করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হচ্ছে। তারা জানে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা কোনো অপরাধ নয়।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘ভারতের সর্বত্র প্রথাগত অস্ত্রধারী হিন্দু দেবতাদের ছবি দেখা যায়। এসব ছবি দেশের প্রতিটি কোণে রয়েছে। তাহলে কি এটি সব মুসলিমদেরও অপমান করে বা তাদের জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হয়? সবার বোঝা উচিত যে সরকার এভাবে কোনো ধর্মকে অপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে না।’

২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে ভারতে গণতান্ত্রিক সূচকগুলোয় ধারাবাহিক অবনতি ঘটেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলেন, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিকারকে অপরাধীকরণ একটি গভীর উদ্বেগজনক নজির স্থাপন করে। ‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো শান্তিপূর্ণ স্লোগানের জন্য মানুষকে টার্গেট করা ভারতীয় সাংবিধানিক আইন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

এ রকম কি আরো ঘটেছে?

সমালোচকরা বলছেন, ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও নিপীড়নের সর্বশেষ উদাহরণ এটি।

গত ১১ বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের নথিভুক্ত ঘটনা ছিল ৬৬৮টি। এক বছরে তা বেড়ে এক হাজার ১৬৫টিতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রায় ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে বেশি ঘটেছে, অথবা যেখানে নির্বাচন আসন্ন।

দিল্লিতে বসবাসকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষক অসীম আলী বলেন, স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম বিরোধগুলো এখন ক্রমবর্ধমানভাবে জাতীয় ইস্যুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই বিদ্বেষ দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মিডিয়া থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আইনের ব্যাখ্যা এমনভাবে দেয়া হচ্ছে, যেখানে মুসলিমদের যেকোনো ধর্মীয় পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশকে উসকানিমূলক বা ঘৃণামূলক অপরাধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

কানপুরে ঘটনার পর, মোদির নির্বাচনী এলাকা বারাণসীর বিজেপি নেতারা অভিযুক্তদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রসঙ্গ টেনে শহরের প্রধান মোড়ে ‘আই লাভ বুলডোজার’ লেখা পোস্টার লাগিয়েছিলেন।

সূত্র : আল জাজিরা