লাদাখে বিক্ষোভের আগুন মোদি সরকারের জন্য কতটা চিন্তার?

যুব-সমাজের এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘লাদাখ অ্যাপেক্স বডি’ ও ‘কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ নামে দুটি সংগঠন। তবে আন্দোলনের মুখ হিসেবে ছিলেন পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদ সোনাম ওয়াংচুক। শুক্রবার তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
লাদাখের আন্দোলনের প্রভাব কাশ্মিরেও পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা
লাদাখের আন্দোলনের প্রভাব কাশ্মিরেও পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা |সংগৃহীত

ভারতের লাদাখ পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে গত বুধবার তরুণদের বিক্ষোভ ও আন্দোলনে সহিংস হয়ে ওঠে। এতে চারজন নিহত হন। আহত হন ৫০ জনেরও বেশি মানুষ।

যুব-সমাজের এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘লাদাখ অ্যাপেক্স বডি’ ও ‘কারগিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ নামে দুটি সংগঠন। তবে আন্দোলনের মুখ হিসেবে ছিলেন ‘থ্রি ইডিয়েটস’ ছবির সূত্রে বহুল পরিচিত পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদ সোনাম ওয়াংচুক। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) আন্দোলরত এই শিক্ষাবিদকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এক পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, লাদাখের বেশ কিছু এলাকায় কারফিউ জারি রয়েছে এবং রাজধানী লেহ শহরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

কারগিল মুসলিম প্রধান অঞ্চল, আর লাদাখে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদার দাবির পাশাপাশি যেই ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী রক্ষাকবচের দাবি জানাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা, সেই তফশিল অনুযায়ী আদিবাসীদের অধিকার, তাদের পরিচয় ও তাদের উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা হয়।

লাদাখ অ্যাপেক্স বডি গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের দাবি নিয়ে অনশন আন্দোলন শুরু করেছিল। সোনাম ওয়াংচুকও ওই অনশনে যোগ দিয়েছিলেন। তবে বুধবারের সহিংসতার পরে ওয়াংচুক বিবিসিকে জানান, অনশন প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং সরকারের সাথে আলোচনা চলছে।

কিভাবে সহিংস হয়ে উঠল আন্দোলন?

শুক্রবার গ্রেফতার হওয়ার আগে বিবিসিকে দীর্ঘ সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন সোনাম ওয়াংচুক। তিনি বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে বড় সংখ্যায় তরুণরা অংশ নিচ্ছেন। যুব-সমাজের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল। তাদের মনে হচ্ছিল যে এতজন মানুষ এতদিন ধরে অনশন করছেন, কিন্তু সরকার ৬ অক্টোবর আলোচনার তারিখ দিচ্ছে। এটাই তাদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। কিন্তু পুলিশের কিছুটা ধৈর্য ধরা উচিত ছিল। তারা শরীরের এমন জায়গা লক্ষ্য করে গুলি না চালাতে পারত যাতে প্রাণ চলে যায়। শুরুর দিকে পুলিশের কোনো ভুল ছিল না, কিন্তু পরে নিরস্ত্র মানুষের ওপরে গুলি চালায় পুলিশ।’

Sonam-Wangchuk

পরিবেশকর্মী ও শিক্ষাবিদ সোনাম ওয়াংচুক

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য ওয়াংচুককেই এই সহিংসতার জন্য দায়ী করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তার উসকানিমূলক ভাষণের জন্যই জনতা ক্ষেপে গিয়ে সহিংসতা শুরু করে। মন্ত্রণালয় এ-ও বলেছে, সহিংসতা শুরু হওয়ার পরেই অনশন আন্দোলন শেষ করে দিয়ে ওয়াংচুক অ্যাম্বুলেন্সে চেপে নিজের গ্রামে চলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি কোনো চেষ্টাই করেননি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবারের ঘটনাক্রম নিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়ে সোনাম ওয়াংচুককে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তিনি বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হতে পারে। শুক্রবার সেই আশংকাই সত্যি হল।

তিনি বলেছিলেন, ‘সরকার আমাকে চুপ করিয়ে দিতে চায়। বুধবার যা ঘটেছে, তার দায় আমার ওপরে চাপিয়ে দিতে চায় সরকার। বেশ কয়েকটা এফআইআর করা হয়েছে, দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। আমাকে গ্রেফতারও করা হতে পারে। আমার স্কুলের জমি ফেরত নিয়ে নিয়েছে সরকার।’

বুধবারের সহিংসতার পরে সামাজিক মাধ্যমে কয়েকজন সোনাম ওয়াংচুকের পাকিস্তান সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।

এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে ওয়াংচুক বলেন, ‘আমি চলতি বছর জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানে যাই। পরিবেশ-সংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের একটা অনুষ্ঠান ছিল সেখানে। আমি তো ওখানে মোদি সাহেবের পরিবেশ-সংক্রান্ত ভাল কিছু কাজের প্রশংসাই করে এসেছি। ওটা খুবই মর্যাদাসম্পন্ন একটা অনুষ্ঠান। শুধু আমি নই, ভারত থেকে আরো ছয়জন বিশেষজ্ঞ ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ওটা তো কোনো গোপন সফর ছিল না।’

‘লাদাখ নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত’

ভারতীয় সেনাবাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় কম্যান্ডের সাবেক কম্যান্ডার-ইন-চিফ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল দীপেন্দ্র হুডা বলেছেন, লাদাখের মানুষের দাবিগুলো খুবই সংবেদনশীল হয়ে শোনা উচিত।

তিনি বলেন, ‘লাদাখকে যখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হলো, তখন সেখানকার মানুষ বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মনে হতে থাকে যে তাদের অধিকার সুরক্ষিত হচ্ছে না। তাদের কাজের সুযোগ বাইরের মানুষ নিয়ে নিচ্ছেন, সংস্কৃতির ওপরে আঘাত আসছে। আমার মনে হয় লাদাখের মানুষের দাবিগুলো ভুল নয়, কিন্তু দাবি আদায়ের পথ তো সহিংস হতে পারে না।’

‘লাদাখ ভারতের কাছে কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ চীন আর পাকিস্তান– দুই দেশেরই সীমানাজুড়ে আছে লাদাখের সাথে। চীনের সাথে লাগোয়া সীমান্তে গত কয়েক বছর ধরেই উত্তেজনা চলছে আবার পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা তো আছেই। ভারতের নিরাপত্তার জন্য লাদাখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা,’ বলছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল দীপেন্দ্র হুডা।

কাশ্মিরেও পড়বে প্রভাব?

লাদাখে যে বিক্ষোভ চলছে, তা নিয়ে জম্মু-কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী উমর আবদুল্লা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক বার্তায় বলেন, ‘লাদাখকে তো রাজ্যের মর্যাদা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। লাদাখের মানুষ ২০১৯ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষিত হওয়ায় উৎসবে মেতেছিলেন কিন্তু এখন তারা ক্ষুব্ধ। তারা নিজেদের প্রতারিত বলে মনে করছেন।’

তিনি বলেন, ‘এখন আপনারাই কল্পনা করুন, জম্মু-কাশ্মিরকে রাজ্যের মর্যাদা দেয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় আমরা কতটা প্রতারিত বোধ করেছি, কতটা নিরাশ হয়েছি আমরা। গণতান্ত্রিক উপায়ে, শান্তিপূর্ণভাবে, দায়িত্বশীলতার সাথে আমরা এই দাবি তুলেছি।’

উমর আবদুল্লার এই পোস্ট দেখে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল দীপেন্দ্র হুডার মনে হয়েছে, লাদাখের আন্দোলনের প্রভাব কাশ্মিরেও পড়বে।

তার কথায়, ‘জম্মু-কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে তো মনে হচ্ছে সেখানেও এই বিক্ষোভের প্রভাব পড়বে। জম্মু-কাশ্মিরকে তো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তবে আমি কাশ্মিরের সাথে লাদাখের তুলনা করব না। কিন্তু কোনো একটা আন্দোলনের প্রভাব তো শুধু সেই রাজ্যের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না।’

তিনি বলেন, ‘এখন পুরো নজর সোনাম ওয়াংচুকের ওপরে পড়েছে। আমি মনে করি কোনো একজন ব্যক্তির ওপরে নজর না দিয়ে, তাকে বিতর্কে টেনে না এনে মানুষের দাবিকে সংবেদনশীলতার সাথে দেখা উচিত। এই আন্দোলন কোনো একজন ব্যক্তি-বিশেষের সাথে জড়িত নয়।’

জম্মু-কাশ্মিরের ঘটনাবলীর ওপরে নজর রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক রাহুল পণ্ডিতা। তিনি বলেন, লাদাখ নিয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত। এই বিক্ষোভ যাতে হাতের বাইরে চলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।

‘আমরা চীনকে কোনো সুযোগ দিতে চাই না। এটা সত্যি যে লাদাখের মানুষ শুরুর দিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বন্দোবস্তকে সমর্থন করেছিলেন। ওখানকার মানুষ সবসময়ে অভিযোগ করতেন যে কাশ্মির উপত্যকায় উপদ্রব হয় আর তার নেতিবাচক প্রভাব তাদের ওপরে এসে পড়ে। কিন্তু এখন তাদের মনে হচ্ছে যে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ব্যবস্থাটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’

তিনি মনে করেন, লাদাখের আন্দোলন যদি সরকার ঠিকমতো সামলাতে না পারে তাহলে তার প্রভাব কাশ্মিরেও পড়বে। সেখানকার যুব-সমাজও লাদাখের আন্দোলনের দিকে নজর রাখছে।

সূত্র : বিবিসি