ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টায় কাশ্মিরের তরুণ প্রজন্ম

‘আমি চাই আমাদের স্থান, ইতিহাস, প্রবাদ-প্রবচন, লোককথা আর কবিতা নিয়ে গল্প বলতে। কিভাবে আমরা বেঁচেছি, হেসেছি, রান্না করেছি আর স্মৃতি তৈরি করেছি, সেটাই ধারণ করি।’

নয়া দিগন্ত অনলাইন
ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টায় কাশ্মিরের তরুণ প্রজন্ম
ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টায় কাশ্মিরের তরুণ প্রজন্ম |বিবিসি

২০২০ সালের গ্রীষ্মের এক বিকেলে কাশ্মিরের একটি মসজিদের ক্যালেন্ডারে নজর পড়েছিল মুনির আহমাদ দারের। সেখানে ছাপা ছিল কাশ্মিরি ভাষায় একটি কবিতা। বিস্ময়ের বিষয় হলো, তিনি সেটি পড়তে গিয়ে কষ্ট অনুভব করেন। তখনই তার মনে হলো, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাশ্মিরি তরুণরা মাতৃভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দি ভাষার প্রভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

এই উপলব্ধি থেকেই দার ‘মুনির স্পিকস’ নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পেজ চালু করেন। যার উদ্দেশ্য কাশ্মিরি সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রচার। পাঁচ বছর পর তার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউব প্রোফাইল মিলিয়ে ৫০ কোটিরও বেশি ইমপ্রেশন অর্জন করেছে।

মুনির দার বলেন, ‘আমি চাই আমাদের স্থান, ইতিহাস, প্রবাদ-প্রবচন, লোককথা আর কবিতা নিয়ে গল্প বলতে। কিভাবে আমরা বেঁচেছি, হেসেছি, রান্না করেছি আর স্মৃতি তৈরি করেছি, সেটাই ধারণ করি।’

দার এখন এক উদীয়মান তরুণ কন্টেন্ট নির্মাতা দলের অংশ। তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছেন কাশ্মিরি ঐতিহ্যের বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলো সংরক্ষণ করতে। দশক ধরে সঙ্ঘাতে জর্জরিত এ অঞ্চল থেকে বহু তরুণ সহিংসতা এড়িয়ে বা ভালো সুযোগের খোঁজে কাশ্মির ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে উঠে আসছে শিল্প, ঐতিহ্য ও সাধারণ মানুষের জীবন- অশান্তি ও রক্তপাতের বাইরের গল্প।

প্রথমে দারের কাজ ছিল ভাষাকেন্দ্রিক। তবে পরবর্তীতে তা বিস্তৃত হয় পুরোনো স্থাপত্য, লোককাহিনী, এমনকি স্থানীয় খাবারের ইতিহাস নিয়েও তিনি কন্টেন্ট তৈরি শুরু করেন। তার এক জনপ্রিয় ভিডিওতে দেখা যায়, প্রাচীন স্থাপত্যে গাঁথুনিকে মজবুত করতে মানুষ এক সময় ডিম ব্যবহার করতো।

ভার্চুয়াল জাদুঘর

‘মিউজিয়াম অব কাশ্মির’ নামে ইন্সটাগ্রাম পেজ পরিচালনা করছেন সাংবাদিক মুহাম্মদ ফয়সল। তিনি কিউরেটর ও মৌখিক ইতিহাসবিদদের সাথে মিলে কাশ্মিরের অবহেলিত শিল্পকর্ম ও ঐতিহ্য নথিভুক্ত করছেন। পেজটিতে বর্ণিল মসজিদের ছাদের ভিডিও, কবিতা পাঠের দৃশ্য ও সংক্ষিপ্ত তথ্যসমৃদ্ধ ক্যাপশন পাওয়া যায়।

অনুসারীরা বলছেন, এই পেজ তাদের কাশ্মিরকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে সাহায্য করছে। এক অনুসারী মন্তব্য করেন, ‘ঐতিহ্য শুধু বিশাল স্থাপত্য নয়; বরং সেই বস্তুগুলোও যা মানুষ ঘর ছাড়ার সময় সাথে নিয়ে গিয়েছিল, যেমন বই, শাল কিংবা পারিবারিক রেসিপি।’

প্রামাণ্যতার চ্যালেঞ্জ

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, মৌখিক ইতিহাসে যথাযথতা বজায় রাখা জরুরি। নইলে সময়ের সাথে সাথে সূক্ষ্ম তথ্য হারিয়ে যেতে পারে। লেখক খালিদ বশীর আহমাদ মনে করেন, কাশ্মিরি গল্প বলার এ উত্থান অবশ্যই একটি পাল্টা-বয়ান। তবে হঠাৎ করে নথিভুক্ত করলে প্রেক্ষাপট বিকৃত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এজন্য নির্মাতারা গবেষকদের সহায়তা নিচ্ছেন, যাতে প্রকাশিত সূত্র দিয়ে কনটেন্ট যাচাই করা যায়।

পশমিনা শালের গল্প

ইন্সটাগ্রামে চলচ্চিত্র নির্মাতা শেখ আদনানের পেজ ‘শলওয়ালা’ নিবেদিত কাশ্মিরি পশমিনা শালের ইতিহাসে। এই শাল হিমালয়ের ছাগলের উৎকৃষ্ট উল থেকে তৈরি হয়, যা বিলাসিতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক।

আদনানের মতে, ‘আমাদের শাল শুধু পোশাক নয়, এটি ইতিহাস ও সহনশীলতার নিদর্শন। প্রতিটি তন্তু একটি গল্প বলে।’ তার ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী ঐতিহ্যবাহী চরখায় সুতা কাটছেন, পেছনে বাজছে কাশ্মিরি লোকগান। ‘আমি চাই বিশ্ব এই অজানা নারীর গল্প জানুক।’

ব্যঙ্গ-রসের ছোঁয়া

সব কন্টেন্টই যে গুরুগম্ভীর, তা নয়। সিরাত হাফিজ নামে ২২ বছরের এক তরুণী অনলাইনে ‘ইকভট’ বা ‘নুন চাই উইথ জিয়া’ নামে পরিচিত। তিনি ব্যঙ্গ-রস ও শব্দখেলা দিয়ে কাশ্মিরি সাহিত্য, ভাষা ও সংস্কৃতিকে সামনে আনছেন। কখনো ভাইরাল মিম ব্যবহার করছেন, কখনো ইংরেজি ক্ল্যাসিকের কাশ্মিরি অনুবাদ তুলে ধরছেন। তার ভাষায়, ‘আমরা ক্রমাগত ভাষা, পরিচয় আর প্ল্যাটফর্ম বদলাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ইতিহাসের বেদনা এখনো বহন করি - even in our humour।’

ভাষার স্বীকৃতির লড়াই

তবে অনলাইনে কাশ্মিরি ভাষার ব্যবহার এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। মুনির দার বলেন, ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে কাশ্মিরি তালিকাভুক্ত নয়। ফলে আমাকে ‘Other language’ অপশন বেছে নিতে হয়। ‘এটি যেন আমাদের ভাষাকে অদৃশ্য করে দিচ্ছে।

২০২৩ সাল থেকে সাহিত্য সংগঠন আদবি মার্কাজ কামরাজ গুগল ট্রান্সলেটে কাশ্মিরি ভাষা যোগ করার দাবি তুলেছে। সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আমিন ভাট জানান, তারা আনুষ্ঠানিক আবেদন ও হাজারো ই-মেইল পাঠালেও এখনো সাড়া মেলেনি।

সব প্রতিকূলতার মাঝেও তরুণ প্রজন্ম নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের বিশ্বাস, কাশ্মিরি সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে না; বরং নতুন রূপে স্মরণযোগ্য হয়ে উঠছে।

মুনির দার বলেন, ‘হয়তো একদিন মানুষ আমার নাম ভুলে যাবে। কিন্তু যদি তারা একটি কাশ্মিরি গল্পও মনে রাখে, যা আমি বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছি, তবে আমার কাজ অর্থবহ হবে।’

বিবিসি নিউজ থেকে ওমর ফারুকের অনুবাদ