সপ্তাহদুয়েক আগের কথা। বিবিসির বিজনেস এডিটর সাইমন জ্যাক যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক জেপি মর্গানের প্রধান জেমি ডিমনের একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, আর সেটি শেষ হওয়ার পরেই কথায় কথায় তিনি একটি ছোটখাটো ‘বোমা’ ফাটান।
ডিমন বলেছেন, মার্কিন প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন, বিস্তর জটিলতার পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুল্ক নিয়ে অবশেষে একটি ‘ব্রেকথ্রু’ হয়েছে। আশা করা যেতে পারে দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়া এখন নেহাত সময়ের অপেক্ষা।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ আর বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রর মধ্যে এই সমঝোতা হয়ে গেলে সেটা যে ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপ হবে, তা নিয়ে জেমি ডিমনের অন্তত কোনো সংশয় ছিল না।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরই মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) হোয়াইট হাউসে দিপাবলি উদযাপনের সময় ভারতীয়-মার্কিনীদের জমায়েতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তার সাথে প্রধানমন্ত্রী মোদির সম্প্রতি টেলিফোনে কথা হয়েছে। আর সেই আলাপের মূল বিষয়বস্তু যে ছিল বাণিজ্য এবং রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল কেনার পরিমাণ কমানো- তা তিনি খোলাখুলি জানিয়ে দেন।
ট্রাম্প যখন এ কথা বলছেন, তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বিনয় মোহন কোয়াটরা। এর একটু পরেই মোদিও টুইট করে জানান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে ফোন করে দিপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং তিনি আশা করেন দুই গণতন্ত্র সারাবিশ্বকে আশার আলোয় আলোকিত করে চলবে। সরাসরি বাণিজ্যের প্রসঙ্গ না উল্লেখ করলেও মোদির বক্তব্যেও সহযোগিতার সুর ছিল স্পষ্ট।
ইতোমধ্যে বুধবার (২২ অক্টোবর) ভারতের প্রথম সারির অর্থনৈতিক সংবাদপত্র ‘দ্য মিন্ট’ তাদের এক প্রতিবেদনে দাবি করে, সংশ্লিষ্ট অন্তত তিনজন সূত্র জানিয়েছেন, ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো ৫০ শতাংশ শুল্ক অচিরেই ১৫ বা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
তারা আরো জানায়, সব ঠিকঠাক থাকলে এ মাসের শেষ দিকে মালয়েশিয়াতে যে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে সেখানেই ট্রাম্প ও মোদির উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য চুক্তির কথাও ঘোষণা করা হতে পারে। তবে আসিয়ানে ট্রাম্পের যাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত হলেও মোদি সশরীরে সেখানে উপস্থিত থাকবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে একমত হয়ে গেলে হয়তো তাকে মালয়েশিয়াতে যেতেও দেখা যাবে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা হোয়াইট হাউস মিন্টের এই রিপোর্ট নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও শুল্ক হ্রাস ও চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা ভারতের শেয়ার বাজারে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৃহস্পতিবার সকালেও ভারতের মুম্বাই শেয়ার বাজারের সূচক প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে সর্বকালীন রেকর্ডের দিকে এগোচ্ছে।
রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমানো
ভারতের রফতানি পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন যে ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছে, তার অর্ধেকটাই রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার জন্য জরিমানা হিসেবে। অন্তত ঘোষিত কারণ এটাই। এই ৫০ শতাংশর মধ্যে বাকি ২৫ শতাংশ হলো পাল্টা শুল্ক। যা মার্কিন পণ্যের ওপর ভারতের বসানো শুল্কের পাল্টা পদক্ষেপ।
এখন সত্যিই যদি এই ৫০ শতাংশ শুল্ক ১৫ বা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে রাশিয়ার সাথে তেল কেনার কারণে আরোপিত ২৫ শতাংশ পেনাল্টির পুরোটাই প্রত্যাহার করতে হবে। পাল্টা শুল্কও অনেকটাই কমাতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বন্ধ করে বা এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিয়েই কেবল ভারত এই সুবিধা আদায় করতে পারে।
ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রশাসনের সূত্রগুলোও বিবিসিকে আভাস দিয়েছেন, রুশ তেলের ‘প্রবাহের দিক পাল্টে’ (রিডায়রেক্টিং ফ্লো) এই সঙ্কটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে। সোজা কথায়, যার অর্থ হলো রাশিয়ার থেকে কম তেল কিনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রমশ ভারতের বেশি তেল কেনা।
দিপাবলির অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের কথা থেকেও আভাস মিলেছে, তিনি এই মুহূর্তে ভারতকে কিছুটা ছাড় হয়তো দিতে রাজি। তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও কমিয়ে আনলেও সেটা হয়তো পথ কিছুটা প্রশস্ত করবে। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এইমাত্র প্রধানমন্ত্রীর মোদীর সাথে কথা হলো, আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। উনি রাশিয়া থেকে আর খুব একটা বেশি তেল কিনবেন না।’
তিনি বলেন, ‘আমার মতো মোদিও চান (রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে) যুদ্ধ বন্ধ হোক। তাই তারা ঠিক করেছেন রাশিয়া থেকে খুব বেশি তেল আর কিনবেন না।’
যে ট্রাম্প আগে জেদ ধরে ছিলেন ভারতকে রাশিয়ার তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে, তার এই নতুন অবস্থানকে পর্যবেক্ষকরা কিছুটা সুর নরম করার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন। রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে ভারতের ঘোষিত অবস্থান হলো, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের বাজার থেকে যেখানে সহজে ও সুলভ মূল্যে তেল পাওয়া যাবে, সেখান থেকেই ভারত তেল কিনবে।
এই যুক্তি আঁকড়ে থাকলেও ভারতের পক্ষে এখন একটা সুবিধাজনক ঘটনাও ঘটেছে। রাশিয়ার তেল কয়েক মাস আগেও আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় যতটা সস্তা ছিল, এখন আর ততটা নেই। গত ৮ অক্টোবর ব্লুমবার্গ তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০২৩ সালেও রাশিয়ার তেল প্রতি ব্যারেলের সাথে বেঞ্চমার্ক তেলের প্রতি ব্যারেলের দামের তফাত ছিল ২৩ ডলার। আর এখন সেটাই নেমে এসেছে মাত্র দুই বা আড়াই ডলারে। যার অর্থ, মধ্যপ্রাচ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের তেল এখন অনেকটাই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে।
ভারত এখন তাদের মোট তেল আমদানির ৩৪ শতাংশের মতো রাশিয়া থেকে করে থাকে। কিন্তু এতে চলতি অর্থ বছরে ভারতের অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের পরিমাণ আগের অর্থ বছরের চেয়ে অনেকটাই কমে গেছে, কারণ রাশিয়ার তেল তুলনামূলকভাবে আর অতটা সস্তা নেই।
মিন্ট জানাচ্ছে, এই পটভূমিতেই শীর্ষ ভারতীয় কর্মকর্তারা সম্প্রতি মস্কো সফরে গিয়ে রাশিয়াকে জানিয়ে এসেছেন, সেখান থেকে তেল কেনার পরিমাণ তারা কমাতে বাধ্য হবেন। তবে এই ঘাটতি মেটাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল কেনা বাড়াতে হবে, কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার মতো দামে কোনো ছাড় দিতে রাজি হয়নি।
বাণিজ্য চুক্তি হলে কোন শর্তে হতে পারে?
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে বিগত বহু মাস ধরে। কিন্তু সেই আলোচনার জট এখনো খোলেনি। এর মধ্যে চুক্তি ঘোষণার ‘ডেডলাইন’ পর্যন্ত একাধিকবার পেছানো হয়েছে। এই চুক্তির পথে প্রধান বাধা ছিল ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের কৃষিজাত, দুগ্ধ ও জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) প্রোডাক্টের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর প্রবেশাধিকার দাবি।
ভারত মনে করে এই প্রবেশাধিকার দিলে তাদের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এই দাবি মানা হচ্ছিল না। মোদীও একাধিকবার বলেছেন, দেশের কৃষকদের স্বার্থের সাথে আপস করে কোনো বাণিজ্য চুক্তি হবে না। এরপর রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনাকে কেন্দ্র করে বিরোধ ও চড়া হারে ভারতের ওপর শুল্ক বসানো সেই আলোচনাকে আরো জটিল করে এবং প্রস্তাবিত চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়।
তবে এখন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ভারত তাদের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের নন-জিএম কর্ন (ভুট্টা) ও সয়মিল (সয়াবিনজাত পণ্য) অনেক বেশি পরিমাণে ঢুকতে দিতে রাজি। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নন-জিএম ভুট্টা আমদানির বার্ষিক কোটা মাত্র পাঁচ লাখ টন, ভারত সেটা অনেকটাই বাড়াতে পারে।
এদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও পোল্ট্রি ফিড, গবাদি পশুর খাদ্য ও ইথানলের মতো বিকল্প জ্বালানির চাহিদাও হু হু করে বাড়ছে। সেটাকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেও ভারত মার্কিন কর্নের জন্য দরজা অনেকটা অবারিত করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দ্য মিন্টকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মানুষ ও গবাদি পশু উভয়ের খাবার উপযোগী নন-জিএম সয়মিল আমদানির অনুমদি দিতেও ভারত প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মার্কিন আলোচনাকারীদের আর একটি প্রধান দাবি- খুব উঁচু মানের চিজসহ মার্কিন দুগ্ধজাত পণ্যে ভারতের শুল্ক কমানো। সেটা নিয়ে ভারত শেষ পর্যন্ত কী অবস্থান নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দিল্লি ও ওয়াশিংটন দুই রাজধানী থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, বাণিজ্য চুক্তির একটা মোটামুটি রূপরেখা প্রায় তৈরি। কিন্তু জ্বালানি ও কৃষিখাতের বেশ কিছু স্পর্শকাতর ইস্যুতে দুইপক্ষ থেকে রাজনৈতিক ছাড়পত্র মিললে তবেই চুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সম্ভব হবে। দিল্লির গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞ অজয় কুমার শ্রীবাস্তব মনে করেন, এই চুক্তি যদি সত্যিই অচিরে সম্পাদিত হয়, তাহলে সেখানেও চীনের একটা পরোক্ষ ভূমিকা থাকবে।
তিনি বলেন, ‘চীন তাদের বিরল খনিজ রফতানির ওপর যেভাবে রাশ টেনে ধরছে এবং মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ যেভাবে দিনকে দিন খারাপ মোড় নিচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। বিকল্প তৈরি করতে নতুন নতুন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী খুঁজছে। চুক্তি সম্পাদনের জন্য এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য অনুকূল হতে পারে।’
এই পটভূমিতেই তার ধারণা, যাবতীয় দরকষাকষি শেষে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভারতকে ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ শুল্কের ব্র্যাকেটে ফেলতে চাইবে। যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাপানের ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি কিন্তু ভিয়েতনামের ২০ শতাংশের চেয়ে কম।
সূত্র : বিবিসি



