ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মনিপুর অশান্ত হয়ে ওঠার দুই বছরের বেশি সময় পরে রাজ্যটি সফরে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে একটি জনসভায় দেয়া বক্তব্যে রাজ্যে পুরোপুরি শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদি।
মনিপুর রাজ্যের চুরাচাঁদপুরে আয়োজিত এক সভায় তিনি শনিবার বলেছেন, ‘আমরা মণিপুরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমি আজ আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমি আপনাদের সাথে রয়েছি। মণিপুরে স্থিতাবস্থা ফেরাতে, শান্তি আনার জন্য সরকার কাজ করছে।‘
প্রসঙ্গত, মণিপুরে ২০২৩ সালের মে মাস থেকে জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর ২৮ মাস কেটে গিয়েছে।
কেন প্রধানমন্ত্রী মণিপুর সফরে যাননি, সে নিয়ে বারবার কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিরোধী দলগুলোও। এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে মণিপুরের বাসিন্দাদেরও।
মণিপুরে প্রধানমন্ত্রী
পাঁচ রাজ্য সফরে বেরিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার কর্মসূচিতে শনিবার রয়েছে মিজোরাম ও মণিপুর। আসন্ন কয়েক দিনে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে যাওয়ার কথা তার। সফরের আগে কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল মণিপুরকে।
শনিবার মিজোরামের কর্মসূচি সেরে মণিপুরের ইম্ফল এবং চুরাচাঁদপুর-এই দুই জায়গায় কর্মসূচি ছিল তার। কুকি অধ্যুষিত চুরাচাঁদপুরে অশান্তির জেরে ঘরছাড়া ব্যক্তিদের সাথে দেখা করার পর জনসভায় উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী মোদি।
সেখানে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী এবং জনসভায় উপস্থিত মণিপুরের রাজ্যপাল অজয় কুমার ভল্লার বক্তব্যে বারেবারে উঠে এসেছে সে রাজ্যের বৈচিত্রময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা, মণিপুরের সার্বিক উন্নয়নের কথা।
গভর্নর ভল্লা জানিয়েছেন, সীমান্তবর্তী এই এলাকার উন্নয়নের দিকে যেমন সরকারের নজর রয়েছে তেমনই সুরক্ষার দিকেও মনোযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি নারী কল্যাণমূলক প্রকল্পে মনোনিবেশ করছে সরকার।
প্রসঙ্গত, অশান্ত মণিপুরে একাধিক নারী নির্যাতনের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছিল। সেই নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়ও হয়েছে।
সরকার যে মণিপুরকে প্রাধান্য দেয় সে বিষয়ে জোর দিয়েছে মোদি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘একটা সময় ছিল যখন দিল্লিতে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ঘোষণা হতো কিন্তু মণিপুরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কয়েক দশক লেগে যেত। কিন্তু এখন আর তা হয় না।‘
মণিপুরের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির কথাও এসেছে তার বক্তব্যে। মোদি বলেছেন, ‘মণিপুরের ভূমি আশা ও উচ্চাকাঙ্খার ভূমি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই সুন্দর অঞ্চলে হিংসার ছায়া পড়েছিল।‘
‘কিছুক্ষণ আগে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে দেখা করেছি, যারা ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে মণিপুরে আশা ও বিশ্বাসের নতুন ভোরের উদয় হতে চলেছে।‘
এরপরই তার বক্তব্যে উঠে এসেছে শান্তি ফেরানোর কথা। মোদি বলেছেন, ‘উন্নয়নের জন্য শান্তি দরকার। গত কয়েক বছরে বছরে নর্থ ইস্টে অনেক বিবাদের সমাপ্তি হয়েছে এবং মানুষ বিকাশকে প্রাধান্য দিয়েছেন।‘
‘(মণিপুরে) হিল (পাহাড়) এবং ভ্যালিতে (উপত্যকায়) বিভিন্ন জনজাতির মানুষের মধ্যে সমঝোতার জন্য আলোচনা শুরু হয়েছে। শান্তি ফেরানোর কাজ চলছে।‘
‘আমি সমস্ত সংগঠনকে অনুরোধ করছি, নিজেদের স্বপ্ন পূরণের জন্য আপনারা শান্তির পথ বেছে নিন। শিশুদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করুন।‘
পাশাপাশি জানিয়েছেন মণিপুরের যুব সম্পরদায়ের সমস্যার কথা তার অজানা নয়। মণিপুরের জনজীবন স্বাভাবিক করতে, ঘরছাড়াদের ফেরাতে, তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে এবং শান্তি স্থাপনের জন্য যে সরকার বদ্ধপরিকর সে বিষয়ে বারবার জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
চুরাচাঁদপুরের সভার পর ইম্ফল উপত্যকায় যান তিনি। এই অঞ্চল মেইতেই অধ্যুষিত। সেখানেও ভিটেহারাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের পরিস্থিতির কথা জানতে চান। একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের শিলান্যাস করেন।
পরে জনসভায় বলেন, ‘২০১৪ সালের আগে মণিপুরের উন্নয়নের হার এক শতাংশেরও কম ছিল। কিন্তু এখন তার গতি কয়েক গুণ বেড়েছে। এখানে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে উন্নয়ন হচ্ছে।‘
ইম্ফলের জনসভায় কথা বলতে গিয়ে কিছুটা ‘ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবেই‘ নেপালের প্রসঙ্গ টেনে আনেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়া সুশীলা কারকিকে অভিনন্দন জানিয়ে যুবসম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘গত দুই-তিনদিন ধরে নেপালের রাস্তা পরিচ্ছন্ন করে তুলতে দেখা গিয়েছে যুবসম্প্রদায়কে। এটা ইতিবাচক এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।‘
এরপরই ভারতের উন্নয়নে মণিপুরের যুব সম্প্রদায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সে বিষয়েও জোর দেন তিনি।
কেন উল্লেখযোগ্য এই সফর
অশান্ত হয়ে ওঠার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মণিপুরে গেলেও প্রধানমন্ত্রী মোদি যাননি। তার এই অনুপস্থিতিকে ঘিরে একদিকে যেমন বিরোধী দলগুলো বিজেপিকে নিশানা করেছে, তেমনই স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
মণিপুরে শান্তি ফেরানোর দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার রাস্তায় নেমেছেন কুকি ও মেইতেই দুই জনজাতির মানুষ। নারীরা মশাল মিছিল করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন মানবাধিকার কর্মীরা এবং ছাত্র সংগঠনের সদস্যরাও।
গত দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে বারেবারে অশান্ত হয়ে উঠেছে এই রাজ্য। রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে উঠেছে, মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। রাজনৈতিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং পদত্যাগ করেছেন এবং মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সহিংসতার কারণে যেসব অঞ্চল সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল, তারমধ্যে অন্যতম চুরাচাঁদপুর জেলা। এখানে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং হাজার হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক মায়ুম শর্মা বলেছেন, ‘এতদিন সাধারণ মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন ছিল, প্রধানমন্ত্রী কবে মণিপুরে আসবেন। সাম্প্রতিক সময়ে দুই কমিউনিটির মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা চলছে। সেই দিক থেকে এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।‘
‘কিন্তু একটা বিষয় বুঝতে হবে, প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর মূলত মণিপুরে উন্নয়নমূলক প্রকল্প উদ্বোধনের জন্য। শান্তি স্থাপনের বিষয়ে সফর হলে তা অনেক আগেই হতো এবং এই বিষয়টাকে ঘিরে মানুষের মনে প্রশ্ন ও ক্ষোভ দুই-ই আছে।‘
অবসরপ্রাপ্ত আইএস কর্মকর্তা পি শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘মণিপুরের অবস্থা এখনো ভালো নয়। আগামী সময় যে খুব উজ্জ্বল, তেমন মনে হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে এসেছেন। মানুষ তাকিয়ে রয়েছে তিনি কী করতে চলেছেন তার দিকে।‘
‘মানুষ জানতে চায়, প্রধানমন্ত্রী এমন কী করবেন যাতে মানুষের অবস্থার উন্নতি হয় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কারণ আমরা ইতিমধ্যে অনেক কিছুই খুইয়েছি।‘
সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন তারা।
শর্মার কথায়, ‘মেইতেই এবং কুকিদের প্রশ্ন, কেন এতদিন প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে আসেননি। অনেকে বলেছেন, এখন যে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য তিনি শেষপর্যন্ত এসেছেন সেগুলো কী সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়েও বড়?‘
ভিটেহারা ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে ডেভিড মায়ুম শর্মা বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মধ্যে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষোভ জমা হয়েছে। ছাত্র সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।‘
‘দীর্ঘদিন মণিপুরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন করা হয়েছিল অশান্তির জেরে। স্থানীয় প্রশাসন সড়ক যোগাযোগের বিষয়ে আশ্বাস দিলেও বাস্তব চিত্র একেবারে আলাদা।‘
পি শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘মণিপুরে এবং দিল্লিতে বিজেপি সরকার থাকা সত্ত্বেও আমরা বিচ্ছিন্ন থেকে এসেছি। তাই মানুষের মনে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক।‘
‘এতে বিভাজন কমবে না‘
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে কুকি ও মেইতেই জনজাতির মানুষের কাছ থেকে।
দিল্লি মেইতেই কো-অর্ডিনেটিং কমিটির কনভেনর সেরাম রোজেশ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এতদিন পর মণিপুরে এলেও মেইতেই গোষ্ঠী তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম মেইতেই এবং কুকি কমিউনিটির মানুষকে একসাথে বসিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। কিন্তু পৃথক পৃথকভাবে দুই কমিউনিটির মানুষের সাথে দেখা করেছেন তিনি।‘
‘এতে বিভাজনের নিয়ম আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি চাইলে অনায়াসেই দুই পক্ষকে মুখোমুখি বসিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। কোন মেইতেই বা কুকি অধ্যুষিত এলাকায় নয়, অন্য কোথাও বৈঠক করতে পারতেন।‘
কুকি ওমেন অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস’র প্রেসিডেন্ট কিম বলেছেন, ‘গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছি, যথেষ্ট হারিয়েছি। নতুন করে আর কি হারাব আমরা। কুকি সম্প্রদায়ের তরফে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা এতেই খুশি যে তিনি অন্তত এতদিন পরে এসেছেন।‘
‘তবে একটা বিষয়, কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে দুই কমিউনিটির সাথে একত্রে দেখা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এতে বিভাজন আরো বাড়বে বলেই আমাদের আশঙ্কা।‘
সূত্র : বিবিসি