ভারতে আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুরা গ্রাম থেকে পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সাকিনা বেগমকে। তারা বলেছিল, থানায় একটা সই করাতে হবে, তারপরে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হবে।
ওই একই সময়ে আসামের কয়েক শ’ মানুষকে এভাবেই ‘সই’ করানোর নাম করে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদের অনেককে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, কারো ঠাঁই হয়েছে ‘বিদেশী’দের আটক-শিবিরগুলোয়।
তবে অনেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে পারলেও ৬৫ বছর বয়সী সাকিনা বেগমের আর কোনো খোঁজ পায়নি তার পরিবার। মাস চারেক পরে তার খোঁজ পেল গনমাধ্যম বিবিসি, বাংলাদেশের ঢাকায়।
যেভাবে খুঁজে পাওয়া গেল সাকিনা বেগমকে
বিবিসি কয়েকদিন আগে জানতে পারে যে মিরপুরের একটি ঘিঞ্জি অঞ্চলে এক বৃদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন, যার বাড়ি ভারতের আসামে। গুগল ম্যাপে সার্চ করে দেখা গেল, ওই বৃদ্ধা যে এলাকার নাম বলছেন, সেই নলবাড়ি আসামের একটি জেলা, সেখানে তার দেয়া নামের গ্রামও আছে।
তবে ভারতের দিক থেকে তার ঠিকানা আর পরিচয় যাচাই করতে হবে।
শুরু হলো খোঁজ।
আসামের নলবাড়ি জেলায় একটি সূত্রের কাছে জানতে বিবিস চায়, বরকুরা গ্রামে সাকিনা বেগম নামে কোনো নারী নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন কি না।
ঘটনাটি অনেকেরই জানা, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে সাকিনা বেগম নামে একজন বৃদ্ধাকে বরকুরা থেকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল মে মাসে। তার আর খোঁজ পায়নি পরিবার। এরপরের ধাপে শুরু হলো পরিচিতি যাচাই করা।
‘এটাই তো আমার মা’
ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতার কাছে ছিল সাকিনা বেগমের ছেলে-মেয়েদের নাম আর তারা কী কাজ করেন, সেই তালিকা।
ভারতে বিবিসির সংবাদদাতা জোগাড় করলেন এক ছেলে আর এক মেয়ের ফোন নম্বর। তারা আবার অসমীয়া ছাড়া কিছু বলতে পারেন না, কারণ তারা খিলঞ্জিয়া মুসলমান। অর্থাৎ আসামের ভূমিপুত্র এবং ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গ থেকে যে বাংলাভাষী মুসলমানদের আসামে চাষ-আবাদের কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক জনগোষ্ঠী। এদের পূর্বপুরুষরা ১২শ শতক নাগাদ আসামে আসেন।
তার বড় মেয়ে রাসিয়া বেগম নামের যে নারীর ফোন নম্বর পাওয়া গিয়েছিল, তার কাছে প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়, ‘সাকিনা বেগম কে হয় আপনার?’
তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, ‘উনি তো আমার মা, কী হয়েছে মায়ের?’ এরপরে তিনি গ্রামেরই এক হিন্দি জানা নারীর সাথে কথা বলিয়ে দেন সংবাদদাতাদের।
তাদের কাছে পুরনো যে ছবি আছে তার মায়ের, সেটা দিতে বলা হয়। অন্যদিকে ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতার হাতে ছিল সাকিনা বেগমের সর্বশেষ ছবি।
দু’টি ছবি মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় বরকুরা গ্রাম থেকে মাস চারেক আগে পুলিশ যে সাকিনা বেগমকে নিয়ে গিয়েছিল, তিনিই ঢাকার মিরপুরে অবস্থানরত সাকিনা বেগম।
নিশ্চিত হয়ে তারপরে আসামে সাকিনা বেগমের বড় মেয়ের নম্বরে ঢাকা থেকে পাওয়া ছবিটা পাঠানো হয়। মুহূর্তে জবাব আসে, ‘এটাই তো আমার মা।’
ঠিক হলো ঢাকার সংবাদদাতা তফসিরুল ইসলাম আর ভারতের সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী একই সময়ে দুই প্রান্ত থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেবেন সাকিনা বেগমের সাথে তার সন্তানদের।
যদিও তার পরিবারকে জানানো হয়নি কবে কথা বলিয়ে দেয়া হবে।
সাকিনা বেগমের বড় মেয়ে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলেন তার মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকার মিরপুরে পৌঁছান তফসিরুল, আর আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুরা গ্রামে পৌঁছান অমিতাভ ভট্টশালী।
নলবাড়িতে তখন হাজির সাকিনা বেগমের তিন মেয়ে ও ছোট ছেলে। বড় ছেলে ব্যাটারিরিকশা চালান, এক দিন কাজে না গেলে খাবার জুটবে না, তাই তিনি নিখোঁজ মাকে দেখতেও আসতে পারেননি।
অধীর আগ্রহে দু’দেশে অপেক্ষা করছিল পুরো পরিবার।
তফসিরুল যখন ভিডিও কলটা করে সাকিনা বেগমকে দেখালেন, ‘দ্যাখেন তো এরা কি আপনার ছেলে মেয়ে হয়?’
ঢাকার ঘুপচি ঘরে বসে ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই তিনি বলে ওঠেন, ‘এই তো আমার মেয়ে...।’
অন্যদিকে ভারতের আসামে গ্রামের বাড়িতে মাকে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন তার ছেলে মেয়েরা.. ‘ওহ... মা গো...।’
তাদের আশপাশে জড়ো হয়েছিলেন কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধু, আর সাকিনা বেগমের পাশে ছিলেন ঢাকায় তার আশ্রয়দাতা পরিবারটি। সকলের চোখেই তখন পানি। কান্নার রোল, ভারতে ফেরার আকুলতা, ছেলে-মেয়ে আর নাতিদের খোঁজখবর কোনো কিছুই বাদ থাকল না।
ভারতের পরিবারটি কৃতজ্ঞতা জানাল ঢাকার পরিবারকে, তাদের মাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য।
মিরপুরের এক পরিবার আশ্রয় দেয়
কয়েক মাস আগে এলাকার এক দোকানের সামনে বসে এক বৃদ্ধাকে কাঁদতে দেখেন বাংলাদেশের মিরপুরের একটি ঘিঞ্জি অঞ্চলের বাসিন্দারা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে যে কী বলছিলেন, সেটা কিছুই বুঝতে পারেননি সেখানকার মানুষ, কারণ তার মুখের ভাষা ভিন্ন।
তিনি শুধু বারবার বলছিলেন যে তার বাড়ি নলবাড়িতে। সেরকম কোনো জায়গা তো বাংলাদেশে নেই... তাহলে কে এই বৃদ্ধা, কীই বা তার পরিচয়?
বৃদ্ধাকে কান্নাকাটি করতে দেখে তাকে আশ্রয় দেয় এলাকারই এক পরিবার।
ধীরে ধীরে মিরপুরের ওই পরিবারটি বুঝতে পারে যে বৃদ্ধার বাড়ি সম্ভবত ভারতে। তিনি কিভাবে বাংলাদেশে এলেন, তা শুনে ইঙ্গিত পাওয়া গেল যে তাকে সম্ভবত ‘পুশইন’ করা হয়েছিল।
সাকিনা বেগম বলছিলেন, ‘থানার পুলিশ আমার গ্রামে গিয়েছিল। বলল আপনার একটা সই নেব, আর আপনাকে নিয়ে আসব। আমার সাথে আমার ছেলেও ছিল। পুলিশ কিন্তু আমাকে থানায় নিয়ে যায়নি।’
‘ওরা হিন্দিতে কথা বলছিল। চারদিকে তারকাঁটার বেড়া। সেখানে একটা বড় লোহার দরজা ছিল। তাদের লোক এসে তালা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল, তোমারা এখান দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাও, হল্লা করো না…, এতটুকুও শব্দ করবেন না,’ ওই বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলছিলেন সাকিনা বেগম।
তখনও তিনি বুঝতে পারেননি যে তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই রাতেই রাস্তায় বাসের দেখা পেয়ে তিনি তাতে উঠে পড়েন।
গত কয়েকমাসে আশ্রয়দাতা পরিবারটিকে তিনি যা জানিয়েছেন তার মাতৃভাষা অসমীয়াতে, তা থেকে ওই পরিবারটির সদস্যরা মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছেন যে সীমান্ত থেকে কিভাবে ঢাকায় এসে পৌঁছিয়েছিলেন সাকিনা বেগম।
ওই পরিবারটির সদস্য ক্লান্তি আখতার বলছিলেন, ‘উনি বাসে ওঠার পরে বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে উনাকে। উনি বলেছেন যে আমি নলবাড়ি যাব।’
বাসের লোকেরা তো আর নলবাড়ি চেনেন না, তাই বারে বারে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছে তাকে। আবারো আরেকটা বাসে উঠেছেন তিনি।
ক্লান্তি বলেন, ‘এভাবে নানা বাসে আসতে আসতে একদিন আমাদের ওইদিক দিয়ে ঢুকে ওখানে একটা দোকান আছে, ওখানে বসে কান্না করছেন।’
‘মাকে খুঁজতে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই’
একদিকে যেমন সাকিনা বেগম বারবার বলেছেন যে তার বাড়ি নলবাড়িতে, অন্যদিকে ভারতে তার ছেলে-মেয়েরা অনেক খুঁজে বেরিয়েছে তাদের মাকে।
ভিডিও কলে কথা বলার আগে সাকিনা বেগমের বড় মেয়ে রাসিয়া বেগম বলছিলেন, ‘সই করানোর জন্য এসপি অফিসে আমার মাকে নিয়ে যায় ২৫ তারিখ (মে মাসের)। আমার ছোট ভাই আর মেজো বোন এসপি অফিসে গিয়েছিল। এসপি অফিস থেকে বলা হয় যে গোয়ালপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে মাকে। এর তিন-চারদিন পরে আমি গোয়ালপাড়া গিয়েছিলাম। গোয়ালপাড়া ক্যাম্পে আমাদের কিছুই বলল না ওরা, বলল যে কোনো অর্ডার হয়নি, ১৫ দিন পরে এসো। দিন ১৫ পরে যখন আমরা যাই, সেখানে আমার মা ছিল না, গোয়ালপাড়ায় নেই। মোট তিনবার গেছি গোয়ালপাড়াতে।’
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, ‘আমার মা আছে নাকি আমার মা মারা গেছে না কী হয়েছে, এটাই তো জানতে পারছি না আমরা। মানুষটার কোনো সন্ধান নেই। মা কোথায় আছে, যে আমি খুঁজতে যাব, সেই ক্ষমতা আমার নেই।’
‘পুশআউটের শিকার?
তার পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং নথিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সাকিনা বেগমকে আসামের বিদেশী ট্রাইব্যুনাল আগেই বিদেশী বলে ঘোষণা করেছে এবং সেই একই রায় বজায় রেখেছে গৌহাটি হাই কোর্টও।
এরপর সাকিনা বেগমকে বিদেশীদের জন্য আটক শিবিরে বন্দী করেও রাখা হয়েছিল। করোনার সময়ে জামিনে মুক্তি পান তিনি। তারপর থেকে নিয়মিত স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে যেতে হতো তাকে।
এই তথ্য জানার পরেই সন্দেহ হয় যে তাকে হয়ত আরো অনেকের মতোই বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় আসাম সরকারেরই দেওয়া একটি তথ্যে।
আসামের বোড়োল্যাণ্ড স্বশাসিত এলাকার সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়ন এবিএমএসইউ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছিল গৌহাটি হাইকোর্টে, যেখানে তারা ২১ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেছিল যে তাদের পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর থেকে পরিবার কোনো খোঁজ পায়নি।
ওই মামলা যিনি দায়ের করেছিলেন, এবিএমএসইউর প্রেসিডেন্ট টাইসন হুসেইন বলছিলেন, ‘এবিএমএসইউ একটা হেল্পলাইন নম্বর জারি করেছিল যে পুরো আসামে যদি এমন কেউ থাকেন যে আসাম পুলিশ আটক করে নিয়ে যাওয়ার পরে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তার পরিবার আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তখনই ২১ জনের তথ্য আমরা পাই, যাদের পুলিশ আটক করে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তারপর থেকে তারা নিখোঁজ। ওই তালিকাতেই নলবাড়ি জেলার সাকিনা বেগম নামে এক নারীর নামও ছিল। ওই ২১ জনের তথ্য আমরা গৌহাটি হাইকোর্টে হলফনামা হিসেবে জমা দিয়েছিলাম।’
হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর এর জবাব দেয়।
টাইসন হুসেইন বলেন, ‘যে ২১ জনের নাম আমরা জমা দিয়েছিলাম তার মধ্যে ১৪ জন কোকরাঝাড় আটক শিবির ও গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন, বাকি সাতজনকে আসাম সরকার বিএসএফকে হস্তান্তর করে দিয়েছে, এমনটাই বলে আসামের স্বরাষ্ট্র দফতর। তখনই বোঝা যায় যে সাকিনা বেগমকে পুশব্যাক করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি যে কোথায় আছেন, এটা আমরা জানতে পারিনি।’
বিএসএফের হাতে, তারপর...?
সাকিনা বেগম এবং আরো ছয়জনের ব্যাপারে আসাম সরকার আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে তাদের বিএসএফের যে সেক্টর হেডকোয়ার্টার আছে ধুবরী জেলায়, তাদের কাছে হস্তান্তর করে দেয়া হয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন আটক-শিবিরে রাখা হয়েছে।
সাকিনা বেগমসহ যাদের বিএসএফের কাছে ২৬ মে হস্তান্তর করা হলো, তারা কোথায় গেলেন?
সাকিনা বেগম একজনের নাম বলতে পেরেছিলেন, যাকে তার সাথে সীমান্ত পার করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সেই নারীর নাম চন্দ্রা বানু, তার বাড়িও নলবাড়ি জেলাতেই। এই নামটি শুনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবিএমএসইউ যে ২১ জন নিখোঁজের তালিকা তৈরি করেছিল, তার মধ্যে এই নামটিও আছে। তবে তার স্বামীর যে ফোন নম্বর ছিল, তাতে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
তবে প্রশ্ন উঠছে, বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করার পরে এরা সীমান্ত পার হলেন কী করে? ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে ইমেইল করে জানতে চেয়েছিল বিবিসি। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার কোনো জবাব আসেনি।
এদিকে বাংলাদেশে বিবিসির পক্ষ থেকে সাকিনা বেগমের ঘটনা জানিয়ে স্থানীয় ভাষানটেক থানায় যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা বলেছেন, ঘটনার তদন্ত এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সাকিনা বেগম আশায় আছেন, এই শেষ বয়সে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার।
আর তার ছেলে-মেয়েরা বলছিলেন, ‘আমার মাকে ছাড়িয়ে এনে দেন… আপনাদের কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি মাকে আমাদের কাছে এনে দেন। মা ছাড়া আর কেউ নেই আমাদের।’ সূত্র : বিবিসি