চীনের তিয়ানজিনে দুই দিন ব্যাপী সফর শেষে সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে দিল্লিতে ফিরে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি সেখানে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও জোটের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা উচ্চহারের শুল্ক মোকাবেলায় ভারতকে যখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে এই সফরকে ভারতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছিল। সফরটির মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও চীনের সাথে ভারতের দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি ওয়াশিংটনকে একটি কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে নিজের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টে করা পোস্টে মোদি লেখেন, ‘চীনে একটি ফলপ্রসূ সফর শেষ করলাম। এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছি, বিশ্বনেতাদের সাথে আলোচনা করেছি এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেছি।’ তিনি আরো লেখেন, ‘সম্মেলন সাফল্যের সাথে আয়োজন করার জন্য প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, চীনা সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানাই।’
চীন, রাশিয়া ও ভারত দীর্ঘদিন ধরেই এসসিও-কে পশ্চিমা বিশ্বের জোট ন্যাটোর বিকল্প একটি মঞ্চ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। আবার নানা কারণে এসসিও-তে সম্পৃক্ততার বিষয়ে ভারতের নানা দ্বিধাও কাজ করেছে। মূলত এর আগের বেশ কয়েকটি এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে নিজে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি তার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরকে। কিন্তু এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে তিনি নিজেই সশরীরে তিয়ানজিনে গেছেন। গত সাত বছরের মধ্যে চীনে এটাই ছিল তার প্রথম সফর।
শি জিনপিং-এর সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
রোববার সফরের প্রথম দিনেই শি জিনপিংয়ের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন মোদি। সেখানে তিনি বলেন, ভারত-চীনের সহযোগিতা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। পৃথিবীর ২৮০ কোটি মানুষ যে এই দু’টি দেশে থাকে, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট শি বার্তা দেন, ‘বিশ্ব আজ একটি রূপান্তরের পথে। এশিয়ার ড্রাগন আর হাতি একসাথে এগোলে তা হবে সময়ের দাবি। আমরা বিশ্বের দুই প্রাচীনতম সভ্য দেশ এবং সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র। আমাদের পরস্পরের বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশী হয়ে একসাথে এগোতে হবে।’
চীন ও ভারত যে পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযোগিতার অংশীদার– সে কথাও বলেন তিনি।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি আরো জানান, ভারত ও চীনের মধ্যে সরাসরি বিমান পরিষেবা অচিরেই চালু হতে যাচ্ছে। যা গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল।
রাশিয়া-ভারত-চীন ‘ট্রয়কা’?
শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবেলায় ভারত এখন চাইবে চীন ও রাশিয়ার কাছাকাছি আসতে। এমন একটা ধারণার কথা সম্প্রতি বহু পর্যবেক্ষকই বলেছেন।
এসসিও সামিটের দ্বিতীয় দিনে দেখা গেছে নরেন্দ্র মোদি, ভ্লাদিমির পুতিন ও শি জিনপিং তিনজনে একসাথে মিলে সৌহার্দ্যের এক বিরল দৃশ্য তুলে ধরছেন। তিন বিশ্বনেতার মধ্যে করমর্দন, আলিঙ্গন ও হাসি-রসিকতা বিনিময়ের মাধ্যমে তিয়ানজিনে এক বিরল অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয়।
এরপরই মোদি এক্সে লেখেন, ‘তিয়ানজিনে কথোপকথন অব্যাহত! প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট শির সাথে মতবিনিময়।’ অন্য আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে দেখা হওয়াটা সব সময়ই আনন্দের।’
এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চের একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, নরেন্দ্র মোদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুতিন ও শিকে কাছে টেনে এনে ঐক্যের প্রতীকী বার্তা দিতে চাইছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফও সম্মেলনস্থলে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি দৃশ্যতই তাকে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন।
সম্মেলনে একটা পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের হাত ধরে হাঁটছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ঠিক সেই মুহুর্তে তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মোদি বা পুতিন কেউই তার দিকে চোখ তুলে তাকাননি, সে দিকে এগোননি শেহবাজ শরিফও।
ভারত ও পাকিস্তান মাত্র কয়েক মাস আগেই পরস্পরের বিরুদ্ধে সামরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, যে যুদ্ধ থামানোর কৃতিত্ব কার তা নিয়ে কূটনৈতিক জলঘোলাও কম হয়নি।
’সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বার্তা’
সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে এসসিও সদস্য রাষ্ট্রগুলো গত ২২ এপ্রিল ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের পেহেলগামে ঘটে যাওয়া হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। ওই হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা ব্যক্ত করা হয় এবং হামলার নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়।
যদিও সেই হামলার জন্য কোনো গোষ্ঠী বা দেশকে অভিযুক্ত করা হয়নি, তারপরও ঘোষণাপত্রে পেহেলগামের অন্তর্ভুক্তিকে ভারত একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছে।
এসসিও-র পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়, এটি পুরো মানবজাতির বিরুদ্ধে হুমকি। এর বিরুদ্ধে দ্বিমুখী নীতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘যে দেশগুলো প্রকাশ্যে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে অবস্থান নিতে হবে। মানবতার স্বার্থে সন্ত্রাসবাদের সব ধরনের রূপকে রুখতে হবে।’
এর আগে পেহেলগাম হামলার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছিল এবং ওই হামলার ১৫ দিন পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিন্দুর’ শুরু করেছিল। তবে এসসিও-র মঞ্চে প্রত্যাশিতভাবেই তিনি উগ্রবাদের সমর্থনকারী হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম করেননি।
চীনের বিরুদ্ধেও পরোক্ষ বার্তা
চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে ‘ফলপ্রসূ’ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করলেও চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) নিয়ে ভারত তাদের আপত্তির বিষয়টিও প্রচ্ছন্নভাবে তিয়ানজিনে তুলে ধরেছে। বিআরআই প্রকল্প যেহেতু পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মিরের মধ্যে দিয়ে যায় এবং সেটিকে ভারত নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে থাকে– তাই চীনের এই প্রকল্পটিকে ভারত নিজেদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখে।
সে কারণেই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে ইঙ্গিত করে মোদি বলেন, ‘সংযোগ তখনই অর্থবহ, যখন তা সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করে। অন্যথায় সেটি কিন্তু আস্থা হারায়।’
পাশাপাশি তিনি এটাও জানান, ভারত চাইছে ইরানের চাবাহার বন্দর ও উত্তর-দক্ষিণ আন্তর্জাতিক করিডরের মাধ্যমে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সাথে টেকসই সংযোগ স্থাপন করতে। ইরানের এই চাবাহার বন্দরটি প্রধানত ভারতের অর্থায়নেই নির্মিত হয়েছে। ভারত একে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে তাদের গেটওয়ে বা প্রবেশমুখ হিসেবে দেখছে।
‘কারপুল কূটনীতি’
এসসিও সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পুতিনের সাথে একই লিমুজিনে চাপেন মোদি। গাড়ির পেছনের সিটে দু’জনে পাশাপাশি বসে তারা শহরের রিটজ কার্লটন হোটেল অভিমুখে রওনা হন। সেখানে দুই নেতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
পথে প্রায় এক ঘণ্টা তারা একান্তে কথাবার্তা বলেন। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম বলছে, ‘এই কথাবার্তা ছিল একেবারেই গোপন। যা অন্যদের কানে পৌঁছানোর জন্য নয়!’
নরেন্দ্র মোদি ও ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বিশেষ ও সুবিধাজনক ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ জোরালো করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আলোচনা হয় ইউক্রেন সংকট নিয়েও। মোদি ওই যুদ্ধের ব্যাপারে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে গঠনমূলক পথে এগোতে হবে।’
এ সময় তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আগামী ডিসেম্বর মাসে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য ২৩তম ভারত-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেন। ‘১৪০ কোটি ভারতীয় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে’, বলেন তিনি।
ক্রেমলিন অবশ্য আগেই জানিয়েছে, এই সম্মেলনে যোগ দিতে প্রেসিডেন্ট পুতিন ডিসেম্বরে ভারত সফর করবেন।
সূত্র : বিবিসি