ভারতকে বাদ দিয়েই কি চীনবিরোধী জোট গড়ছে যুক্তরাষ্ট্র

এরই মাঝে নতুন ইস্যুতে কপালে ভাঁজ পড়েছে নয়া দিল্লির। চীনকে ঠেকাতে এবার ভারতকে এড়িয়ে নতুন জোট গড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে কোয়াডের অপমৃত্যু ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
মোদি-ট্রাম্প-শি জিনপিং
মোদি-ট্রাম্প-শি জিনপিং |সংগৃহীত

মার্কিন নানা মন্তব্য ও সিদ্ধান্তে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে। এর প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে। এরই মাঝে নতুন ইস্যুতে কপালে ভাঁজ পড়েছে নয়া দিল্লির। চীনকে ঠেকাতে এবার ভারতকে এড়িয়ে নতুন জোট গড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে কোয়াডের অপমৃত্যু ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কোয়াড অর্থাৎ ‘কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ অথবা চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপ। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটির সদস্যপদ রয়েছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার। চলতি বছরের নভেম্বরে নয়াদিল্লিতে এর রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। ওয়াশিংটনের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস’ জানিয়েছে, এবারের কোয়াডের বৈঠকে ট্রাম্প যোগ দেবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট জোটটি নিয়ে তার সরকারের যে আগ্রহ কমেছে, তা বলাই বাহুল্য।

২০০৭ সালে কোয়াডের জন্ম হলেও মাত্র এক বছরের মধ্যেই ‘শীতঘুমে’ চলে যায় এই সংগঠন। প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ফের একে পুনরুজ্জীবিত করেন ট্রাম্প। সেটা ছিল ২০১৭ সাল। পরবর্তী আট বছরে ধীরে ধীরে সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নিয়ে এগোয় এই চতুঃশক্তি জোট। কিন্তু দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট গোটা প্রক্রিয়ায় যে পানি ঢেলেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা কোয়াড নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ হারানোর নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তাদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই এই গোষ্ঠীটিকে একটি সামরিক জোট হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছে আমেরিকা। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়েছে নয়াদিল্লি। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত বিবাদকে কেন্দ্র করে চীনের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদি সরকার আরো বেশি করে সুর চড়াক, চাইছে ওয়াশিংটন। অন্য দিকে বেইজিংয়ের সাথে সঙ্ঘাত দ্বিপক্ষীয়ভাবে মিটিয়ে নিতে বেশি আগ্রহী ভারত।

কোয়াডের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনা ‘দৌরাত্ম্য’ হ্রাস। নয়াদিল্লিকে সাথে নিয়ে সেই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব নয় বলে মনে করছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্প চাইছেন, কোয়াডকে শক্তিশালী করতে শুধুমাত্র ওয়াশিংটনের থেকে হাতিয়ার কিনুক এ দেশের ফৌজ। এ ব্যাপারে রাশিয়ার সাথে মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে তার। উল্টো দিকে, যেকোনো ধরনের একমুখী জোটে যেতে নারাজ ভারত।

এছাড়া প্রস্তাবিত বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে নয়াদিল্লির উপর চাপ তৈরির অভিযোগ উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টের উপরে। এ দেশের পণ্যে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে রেখেছেন তিনি। পাশাপাশি, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সাথে অত্যধিক ‘মাখামাখি’ করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে সামান্য চিড় ধরেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে কোয়াড-ধ্বংসের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

এ দেশের পণ্যে ট্রাম্প ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পর চুপ করে বসে থাকেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর বৈঠকে যোগ দিতে চীন সফর করেন তিনি। সেখানে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে কথা হয় তার। এতে ওয়াশিংটনের রক্তচাপ যে বেড়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চতুঃশক্তি জোটে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া থাকলেও ভারত ও আমেরিকাকে এর মূল ভরকেন্দ্র বলা যেতে পারে। সংবাদসংস্থা ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইসম’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে নয়াদিল্লির সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে কোয়াডে অদলবদল চাইছে ওয়াশিংটন। সেখানে ভারতকে বাদ দিয়ে ফিলিপাইনকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনেরই সকলে একমত নন।

গত ১ নভেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেন মার্কিন যুদ্ধসচিব পিট হেগসেথ। ২০২৫ সালে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে এই ধরনের আলোচনা করলেন তিনি। পরে চারটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জারি করা যৌথ বিবৃতিতে সরাসরি নাম করে চীনকে দেয়া হয় কড়া হুঁশিয়ারি। এত দিন পর্যন্ত কোয়াডের বৈঠকে যা নয়াদিল্লি, ওয়াশিংটন, টোকিয়ো এবং ক্যানবেরাকে করতে দেখা গিয়েছে।

মার্কিন যুদ্ধসচিবের এই বৈঠকের পরেই কোয়াডে সদস্য বদলের ব্যাপারে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের দাবি, ফিলিপাইনকে এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে একটি সেনাঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াশিংটনের। তবে চতুঃশক্তি জোট থেকে ভারতকে বার করে দেয়া আমেরিকার পক্ষে মোটেই সহজ নয়। কারণ, জনসংখ্যা, অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নয়াদিল্লির মতো যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো ঘনিষ্ঠ ‘কৌশলগত অংশীদার’ নেই।

তবে কোয়াডে সদস্য বদল হলে চীনকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে ভারতের সমর্থন হারাবে ওয়াশিংটন। সেক্ষেত্রে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার যাবতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব গিয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে। আর তাই সংশ্লিষ্ট চতুঃশক্তি জোটটির সম্প্রসারণ চাইছে ট্রাম্প প্রশাসনের একাংশ, খবর সূত্রের। ফলে কোয়াডে ফিলিপাইনের অন্তর্ভুক্তি সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের কথায়, আমেরিকা জানে কোয়াডের সম্প্রসারণে ফিলিপাইনের অন্তর্ভুক্তি হলে কোনো আপত্তি করবে না ভারত। কারণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির সাথে নয়াদিল্লির সম্পর্ক ভালো। সম্প্রতি ম্যানিলাকে ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে নয়াদিল্লি। চীনা রণতরীগুলোকে নিশানা করতে ওই ব্রহ্মাস্ত্রটিকে বাহিনীর বহরে শামিল করেছে ফিলিপাইন। এতে দু’তরফে সম্পর্ক বেশ মজবুত হয়েছে।

মার্কিন বিশ্লেষকদের অপর অংশের দাবি, কোয়াডকে রেখেই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আর একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চাইছে আমেরিকা। তাতে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি থাকবে ফিলিপাইন। কোয়াড ছাড়া এই অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আরো একটি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। তার নাম ‘অকাস’। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এর সদস্যপদ পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া এবং গ্রেট ব্রিটেন (পড়ুন ইউনাইটেড কিংডম)।

কুয়ালালামপুরে আমেরিকার যুদ্ধসচিবের সাথে বৈঠকের পর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ফিলিপাইন। আগামী বছর ‘বালিকাতান-২০২৬’ যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করবে ম্যানিলা। সেখানে বাকি সদস্য দেশগুলোর ফৌজকে অংশ নিতে দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্পের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য পিট হেগসেথ।

‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস’ জানিয়েছে, কোয়াড সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে চীনকে ঘিরতে চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধে খুব একটা এঁটে উঠতে পারেননি তিনি। উল্টে আমেরিকায় বিরল খনিজের রফতানি কমিয়েছে ড্রাগন সরকার। ফলে বৈদ্যুতিক সামগ্রী থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা বা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণে বিপদ বেড়েছে ওয়াশিংটনের। আর তাই চতুঃশক্তি জোটকে কলেবরে বাড়িয়ে মান্দারিনভাষীদের উপর ভূ-রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে চাইছেন ট্রাম্প।

নভেম্বরের শুরুতে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ফিলিপাইনের পাশাপাশি কুয়ালালামপুরে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সাথেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মার্কিন যুদ্ধসচিব পিট হেগসেথ। এরপর ১০ বছরের জন্য একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করেন তারা। সেখানে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের যৌথ উদ্যোগে হাতিয়ার তৈরির কথাও বলা রয়েছে।

গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প শপথ নেয়ার পরই কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিয়ো। জুলাইয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য আলোচনায় বসেন তারা। পরবর্তী সময়ে আলাস্কায় মার্কিন ফৌজের সাথে সামরিক মহড়ায় অংশ নেয় ভারতীয় সেনা।

ফলে কোয়াডের ভবিষ্যৎ এখনই ‘বিশ বাঁও জলে’, এ কথা মানতে নারাজ বিশ্লেষকদের একাংশ। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতের সাথে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলতে চেষ্টা চালাচ্ছে আমেরিকা। সেখানে সাফল্য এলে দু’তরফে অনেকটাই মিটে যাবে শুল্কের সমস্যা। তখন ফের এক টেবলে চতুঃশক্তি জোটের নেতা-নেত্রীদের বসতে দেখা যায় কিনা, তার উত্তর দেবে সময়।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা