দত্ত শিরকে গত দুই দিন ধরে তার বাড়ি থেকে বের হননি। তিনি তার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন কারণ তিনি যে গলিতে থাকেন সেখানে সম্প্রতি হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে যানবাহন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
দত্ত শিরকের থেকে মাত্র এক মাইল দূরেই থাকেন আসলাম। তিনি তার প্রথম নাম দিয়ে পরিচয় প্রকাশ করতে বলেছিলেন কারণ তিনিও একইভাবে আতঙ্কিত। আসলাম তার মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করবে। তার মতে, পুলিশ নিরীহ মুসলমানদের আটক করছে।
তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই করিনি। কিন্তু পুলিশ এলে ওদের চোখ যেন আমাদের রক্তই খুঁজে বেড়ায়।’
তারা দুজনেই পশ্চিম ভারতে অবস্থিত মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাগপুরের বাসিন্দা, যেখানে সোমবার ১৭ শতকের মুঘল শাসক আওরঙ্গজেবের কবর নিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
সহিংসতার পর পুলিশ কারফিউ জারি করেছে এবং ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাগপুর সফরের আগে অভিযান চালিয়ে ৫০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই মুসলিম। এই শহরেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সদর দফতর অবস্থিত, যা মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও তার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মিত্রদের আদর্শিক পথপ্রদর্শক।
কেন নাগপুরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল?
গত সপ্তাহে মহারাষ্ট্রের একজন বিজেপি সাংসদ মুঘল সম্রাটের সমাধি খননের দাবি জানান। সোমবার নাগপুরে উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) সাথে যুক্ত প্রায় ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবক আওরঙ্গজেবের কবর ভেঙে ফেলার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। তারা বলেন, ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত তার রাজত্বকালে তিনি হিন্দুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছিলেন এবং তাদের উপাসনালয়ে আক্রমণ করেছিলেন।
ভিএইচপির মুখপাত্র অমিত বাজপেয়ী বলেন, ‘ওই কবর আমাদের জন্মভূমিতে একটি কালো দাগ। আমরা একটি চত্বরের কাছে জড়ো হয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে সবুজ কাপড়ে মোড়ানো আওরঙ্গজেবের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি।’ তিনি প্রতিবাদের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যা সঠিক মনে করি তা দাবি করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।’
আইনজীবী ও মহারাষ্ট্র বার কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান আসিফ কুরেশি বলেন, মুসলিম দোকানদারসহ দর্শনার্থীরা পুলিশের কাছে বিক্ষোভ বন্ধের দাবি জানান। তিনি ওই এলাকায় বসবাস করেন।
কুশপুত্তলিকায় মোড়ানো সবুজ কাপড়ে কুরআনের আয়াত লেখা ছিল বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যা মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করে। সেই সন্ধ্যায় ইফতার করে মাগরিবের নামাজ পড়ার পর, মুসলিমদের একটি দল পাল্টা প্রতিবাদ করে। তারা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশকে মামলা দায়েরের দাবি জানায়।
কুরেশি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, খুব দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং ক্ষুব্ধ লোকেরা সংঘর্ষ শুরু করে।’
শহরের যে অংশে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল সেখানে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে কারফিউ জারি করেছে। কারফিউ জারির পরই পুলিশি অভিযান শুরু হয়। কুরেশি বলেন, পুলিশের উচিত ছিল সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদের গ্রেফতার করা। তারা তা না করে যারা কেবল নামাজ পড়তে বের হয়েছিল সেই সব নিরাপরাধ মুসলিমদের গ্রেফতার করেছে।
সংঘর্ষের পর ভিএইচপির বাজপেয়ী বলেন, ‘এখন আমরা আরো কঠোরভাবে প্রতিরোধ করব। কেন মুসলিমরা মনে করে যে তারা দাঙ্গা করে আমাদের ভয় দেখাতে পারবে? আমরা চাই আওরঙ্গজেব এখান থেকে চলে যাক।’
মঙ্গলবার মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মনে করেন, সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বলিউড ছবিতে আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটি হিন্দুদের ভাবাবেগে উস্কানি দিতে ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। ছাবা নামক ওই ছবিটিতে মুঘল শাসক ও মারাঠাদের মধ্যে যুদ্ধের কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মুঘল শাসকরা আজকের মহারাষ্ট্রের বিশাল অংশ শাসন করত। ফড়নবিশ বলেন, ছবিটি আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছে। ফড়নবিশ মোদির বিজেপি দলের একজন সদস্য।
আওরঙ্গজেব কে ছিলেন?
আওরঙ্গজেব ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসকদের একজন এবং তার সমাধি নাগপুরে নেই। সমাধিটি ৪৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত একটি শহরে অবস্থিত। এটি ২০২৩ সাল পর্যন্ত শাসকের নামে নামকরণ করা হয়েছিল আওরঙ্গবাদ। কিন্তু পরে এর নামকরণ করা হয়েছে ছত্রপতি সম্ভাজিনগর।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর চাপে নামটি পরিবর্তন করা হয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরেই আওরঙ্গজেবকে ভারতের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত খলনায়ক হিসেবে দেখে আসছে। কিন্তু ইতিহাসবিদরা মনে করেন, আজ ভারতে আওরঙ্গজেবের যে চিত্রায়ন দেখা যাচ্ছে, তার থেকেও মিশ্র ঐতিহ্য রয়েছে তার।
ইতিহাসবিদ ও ‘আওরঙ্গজেব : দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ বইয়ের লেখক অড্রে ট্রুশকে বলেন, আওরঙ্গজেব তার পিতাকে বন্দী করে এবং তার বড় ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করার পর উত্তরাধিকারসূত্রে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য লাভ করেন। কিন্তু ক্ষমতালোভী এই সম্রাট তার সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রেও অতুলনীয় ছিলেন এবং জোট গঠনে অসাধারণ ছিলেন।
ট্রুশকে বলেন, তার নীতিগুলোকে আরেক মুঘল সম্রাট ও তার প্রপিতামহ আকবর ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
পশ্চিম ভারতের প্রধান হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যে সব ধরণের গোষ্ঠী নিয়ে এসেছিলেন। একজন রাজপুত্র হিসেবে তিনি সমগ্র সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেছিলেন এবং লেখাপড়া করেছিলেন। তিনি মারাঠা থেকে রাজপুত পর্যন্ত সকল গোষ্ঠীর সাথে তার সংযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং পরে তাদের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়েছিলেন।’
কিন্তু আওরঙ্গজেব কঠোর ইসলামী আইন ও একটি বৈষম্যমূলক কর আরোপ করেছিলেন যা সুরক্ষার বিনিময়ে হিন্দু বাসিন্দাদের দিতে হত। ট্রুশকে বলেন, ‘আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন অত্যন্ত জটিল রাজা যার অনেক দিক ছিল।’
তিনি বলেন, হিন্দু অতি-ডানপন্থীরা প্রায়ই আওরঙ্গজেবকে একজন ধর্মীয় উগ্রবাদী হিসেবে চিত্রিত করলেও মুঘল সম্রাট তার রাজত্বকালে বারবার দেখিয়েছিলেন যে তিনি বিশ্বাস নয় বরং ক্ষমতার মাধ্যমে শাসন করতেন।
ট্রুশকে বলেন, ‘যখনই ধার্মিকতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিত, প্রতিবারই তিনি ক্ষমতা বেছে নিতেন।’
ভারতে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে কেন এত বিভেদ?
অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন, সেই সময় রাজারা সাধারণত গণতান্ত্রিক ছিলেন না। ট্রুশকে বলেছেন, ‘অনেক দিক দিয়েই আধুনিক-পূর্ব যুগে আওরঙ্গজেব ভারতীয় রাজাদের থেকে বিশেষভাবে আলাদা ছিলেন না।’
তিনি বলেন, কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা তার নিন্দা করেছে। বিজেপি ও আরএসএস যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত, তারা মূলত ঔপনিবেশিক যুগের প্রচারণার পুনরাবৃত্তি করছে।
আওরঙ্গজেব-বিরোধী মনোভাব ক্রমশ আক্রমণাত্মক, এমনকি হিংসাত্মক উপায়ে প্রকাশ পাচ্ছে।
একটি মিছিলে আওরঙ্গজেবের পোস্টার টানানোর জন্য ২০২৪ সালে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের জুন মাসে শাসকের ওপর একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টের ফলে ১৪ বছর বয়সী এক মুসলিম ছেলেকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। ২০২২ সালে মোদী সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে মুঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো থেকে কিছু অংশ কেটে দেয়। বইয়ে আওরঙ্গজেব ও তার পূর্বপুরুষদের মতো সম্রাটদের কৃতিত্বের বিবরণ লেখা একটি টেবিল সরিয়ে ফেলা হয়।
মোদি ও তার রাজনীতির অনেক সমর্থকের কাছে আওরঙ্গজেব কেবল ইতিহাস নন। তারা বিশ্বাস করে, তিনি অনেক মন্দির ধ্বংসের পক্ষে ছিলেন। তবে অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের জন্য অনুদান ও জমি দেয়ার জন্যও তিনি পরিচিত।
এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা উত্তর প্রদেশের মোদির সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা বারাণসীর জ্ঞানবাপি মসজিদের ওপর দাবি করেছে। তাদের দাবি, মসজিদটি ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ধ্বংসপ্রাপ্ত ১৬ শতকের একটি বিশাল হিন্দু মন্দির বিশ্বনাথ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত হয়েছিল।
বারাণসীতে ২০২২ সালে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মোদি ‘আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা ও তার সন্ত্রাস’ সম্পর্কে কথা বলেন এবং আরো বলেন, ‘তিনি তরবারির জোরে সভ্যতা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ধর্মান্ধতা দিয়ে সংস্কৃতিকে চূর্ণ করার চেষ্টা করেছিলেন।’ এরপর থেকে মোদি আরো বেশ কয়েকবার তার নাম উচ্চারণ করেছেন।
নাগপুরে সংঘর্ষের একদিন পর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ফড়নবিস বলেন, ‘এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সরকারকে আওরঙ্গজেবের নিপীড়নের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও তার কবর সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে।’
১৯৫৮ সালের একটি আইনের অধীনে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ কর্তৃক আওরঙ্গজেবের কবর জাতীয় গুরুত্বের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে সুরক্ষিত। আইনটি কবরকে অননুমোদিত পরিবর্তন বা ধ্বংস থেকে রক্ষা করে।
এদিকে নাগপুরে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাসিন্দারা ও স্থানীয় কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, আরো সহিংসতা ঘটতে পারে।
শিরকে বলেন, ‘একে অপরের প্রতি কোনো আস্থা বা বিশ্বাস নেই। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমার প্রতিবেশী সুযোগ পেলে আমার পরিবারের ক্ষতি করবে না।’
কুরেশি বলেন, মুসলিম বাসিন্দারা অভিযানের ভয়ে বাস করেন এবং আশা করেন যে রাজ্য কর্তৃপক্ষ পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে।
তবে ট্রুশকের মতে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ইতিহাস নিয়ে যে আচ্ছন্নতা, তা মূলত তাদের আন্দোলনের মুসলিম বিদ্বেষকেই প্রকাশ করে, সেটা অতীতে হোক বা বর্তমানে। তিনি বলেন, সম্প্রদায় ও জাতিগুলো কিভাবে গঠিত হয়েছে তা বোঝার জন্য ইতিহাস জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১৭ শতকে যা ঘটেছিল তার জন্য এখন মামলা করা একটি পাগলামি।
অনুবাদ: আফরা সাইয়ারা পরমা