ভারতের ভোটার তালিকায় ‘সংশোধন‘, কয়েক লাখ নাম বাদ যাওয়ার আশঙ্কা

ভারতের নির্বাচন কমিশন সোমবার বিকেলে ঘোষণা করেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে দেশের ১২টি রাজ্যে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভোটার তালিকায় ‘নিবিড় সংশোধনের‘ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
এসআইআর নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ অনেক রাজ্যের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক
এসআইআর নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ অনেক রাজ্যের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক |বিবিসি

ভারতের নির্বাচন কমিশন সোমবার বিকেলে ঘোষণা করেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে দেশের ১২টি রাজ্যে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভোটার তালিকায় ‘নিবিড় সংশোধনের‘ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরালা, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশসহ ১২টি রাজ্যের তালিকায় আসামের নাম নেই। যদিও পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর সাথেই আসামেও মাস ছয়েকের মধ্যে বিধানসভার নির্বাচন হওয়ার কথা।

তার আগেই এই নিবিড় সংশোধন বা স্পেশাল ইনটেন্সিভ রিভিশন – এসআইআর প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় নথি না দেখাতে পারলে বহু মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিরোধী দলগুলো।

কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা দাবি করে আসছেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো কিছু রাজ্যে বহু কথিত বাংলাদেশী ভোটার তালিকায় নাম তুলে ফেলেছেন। ‘নিবিড় সংশোধন‘ হলেই বাদ পড়বে ‘অবৈধ বাংলাদেশী‘ ও ‘রোহিঙ্গারা‘।

তবে এই প্রক্রিয়ায় ভারতের মুসলমানদের একাংশের নামও বাদ দিয়ে দেয়া হবে না তো – প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। মুসলমানদের মধ্যেও ভোটাধিকার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন মাঠপর্যায়ে কাজ করেন এমন সামাজিক কর্মকর্তারা।

বিহারে আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে একইভাবে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন চালিয়ে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষের নাম বাদ দিয়েছে কমিশন। এদের মধ্যে একটা বড় অংশই বিবাহিত নারী ও পরিযায়ী শ্রমিক বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

নির্বাচন কমিশন যা ঘোষণা করল

সোমবার বিকেলে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্য এক সংবাদ সম্মেলনে এসআইআর বা ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের বিস্তারিত ঘোষণা করেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার ওই সংবাদ সম্মেলনে জানান, ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মঙ্গলবার থেকেই এসআইআরের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। তবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম বিলি করা হবে ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

কুমারের কথায়, ‘নিবিড় সংশোধনের উদ্দেশ্য হলো যাতে একজনও বৈধ ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়েন, আর একজনও অবৈধ ভোটারের নাম যাতে তালিকায় না থাকে, সেটি নিশ্চিত করা।‘

ভোটারদের বাড়ি গিয়ে যে ফর্ম দেয়া হবে, তার কিছুটা অংশ আগে থেকেই ছাপা হয়ে থাকবে। তবে বাকি অংশটা ভর্তি করতে হবে ভোটারদেরই।

এই পর্যায়েই একজন ভোটারকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে হবে- তার নিজের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় আছে কিনা, তা দেখে ‘লিঙ্ক‘ করতে হবে নিজের নাম।

যদি আগের তালিকায় তার নাম না থাকে, তাহলে তাদের পরবর্তীকালে নোটিশ পাঠাবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। তখন জন্মের নথি বা অভিভাবকের নথির মতো ১২টি নথি দেখে কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে।

অনলাইনেও এই প্রক্রিয়ায় নিজের নাম আগের তালিকার সাথে ‘লিঙ্ক‘ করা যাবে বলে জানিয়েছেন কুমার।

এসআইআর নিয়ে কেন উদ্বেগ?

যেকোনো ভোটের আগেই ভোটার তালিকায় সংশোধন ও পরিমার্জন একটি রুটিন প্রক্রিয়া। তবে ২০০২-২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশন সারা দেশে একটি নিবিড় সংশোধন চালিয়েছিল।

বিহারে ওই ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকেই ভিত্তি হিসেবে গণ্য করে এ বছর নিবিড় সংশোধন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও কয়েক মাস আগেই ২০০২ সালের ভোটার তালিকা ওয়েবসাইটে আপলোড করে দেয়া হয়েছে।

দীর্ঘ দিন ধরেই নাগরিকত্ব নিয়ে গবেষণা ও আন্দোলন করেন সদ্য কংগ্রেস দলে যোগ দেয়া অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসু। তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব সুরক্ষাসংক্রান্ত বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান।

বসু বলছিলেন, ‘বিহারে এসআইআর নিয়ে যেসব জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে, সেগুলোর এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। আগামী ৪ নভেম্বর শুনানি আছে। নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল সেই মামলাগুলো শেষ হওয়ার পরে নতুন করে অন্যান্য রাজ্যে এসআইআর ঘোষণা করা।

‘বিহারে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়েছে। এদের মধ্যে একটা অংশ মৃত বা স্থানান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু বাদ পড়াদের মধ্যে সিংহভাগই বিবাহিত নারী বা পরিযায়ী শ্রমিক। এরা বিহারের আসন্ন নির্বাচনে আর ভোট দিতে পারবেন না। অন্যদিকে তাদের নাম যে নতুন বসবাসের জায়গায় তোলা হয়েছে, তাও না। অর্থাৎ এই লক্ষ লক্ষ মানুষ ভোটাধিকার হারালেন।’

তবে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সোমবার সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, বিহারের নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বসুর কথায়, ‘আবার ২০০২ সালকে কেন ভিত্তি বছর হিসেবে ধরা হচ্ছে, তা নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলেছি।‘

ভোটারকেই খুঁজতে হবে পুরনো তালিকায় নিজের নাম

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতরের সূত্র উদ্ধৃত করে কয়েকটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম কয়েকদিন আগেই জানিয়েছিল যে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়, ২০০২-এর এবং সাম্প্রতিক ভোটার তালিকায় গড়ে ৫০ শতাংশ নামের ‘অমিল‘ পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশন যে প্রাথমিক ‘ম্যাপিং‘ চালিয়েছিল, অর্থাৎ ২০০২ সালের তালিকা আর ২০২৫-এর তালিকায় নামের অমিল কত, সেই হিসাব কষা হয়েছে।

প্রসেনজিৎ বসু বলছিলেন, ‘২০০২ এর তালিকাটি ডিলিমিটেশন হওয়ার আগের তালিকা। ওই সময়ে যেসব কেন্দ্র ছিল, তার মধ্যে অনেক কেন্দ্র এখন বিলুপ্ত, আবার কিছু কেন্দ্রকে অন্য কেন্দ্রের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। আজকের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে সেই সময়ে কোন বুথে ভোট দিতেন একজন মানুষ, সেটা তাকে মনে রাখতে হবে। একজন সাধারণ ভোটারের পক্ষে সেই তথ্য মনে রাখা অসম্ভব। কিন্তু তাকেই নিজের নাম ২২ বছর আগের তালিকা থেকে খুঁজে বার করতে হবে! এই তথ্য তো নির্বাচন কমিশনেরই দেয়া উচিত।‘

কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সোমবার ঘোষণা করেছেন, ভোটারকেই খুঁজে বার করতে হবে যে তার নাম আগের তালিকায় ছিল কি না।

তিনি বলেছেন, বড়জোড় বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক বা স্থানীয় বুথ পর্যায়ের অফিসাররা সহায়তা করতে পারেন।

সমাজ গবেষক সাবির আহমেদ বলছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি ধরা হয়, এখানে মাত্র ১৫ শতাংশ বাড়িতে ইন্টারনেট আছে, সেখানে কীভাবে গ্রামের, অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ ইন্টারনেট দিয়ে নিজের ভোটাধিকার রক্ষা করবেন? মোবাইল থাকা বা হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড করা আর পুরনো ভোটার তালিকা থেকে নিজের নাম খুঁজে বার করার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা কি আমাদের নীতি নির্ধারকরা বুঝতে পারছেন না?‘

মুসলমান আর পরিযায়ী শ্রমিকদের আশঙ্কা

নিজেদের ভোটাধিকার সুরক্ষিত রাখতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে যাদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ মুসলমান বলে দাবি করছেন কয়েকজন গবেষক ও সামাজিক কর্মকর্তা।

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে যখন ২০১৯ সাল থেকে আন্দোলন চলছিলে, কলকাতায় তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন ফরিদুল ইসলাম।

‘গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলো এসআইআর নিয়ে এমনভাবে মানুষকে ভয় দেখিয়েছে যে তারা সত্যিই আতঙ্কিত, অনেকেই মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং এদের একটা বড় অংশ মুসলমান। বরং কলকাতা শহরে আমি যে অঞ্চলে থাকি, সেখানকার বহু মানুষ জানেনই না এসআইআর ব্যাপারটা।’

সমাজ গবেষক সাবির আহমেদ বলছিলেন, ‘এখন যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা একটা কথা বার বার বলছেন যে অবৈধ ভোটারে তালিকা ভরে গেছে ইত্যাদি। এত অবৈধ ভোটারই যদি থেকে থাকবে, তাহলে তাদের ভোটেই তো তারাও জয়ী হয়েছেন! দোষটা নাগরিকদের ওপরে চাপিয়ে দেয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকর।

‘মুসলমানরা এবং আদিবাসীদের এই প্রক্রিয়ায় হেনস্থার মুখে পড়তে হবে। তাদের মধ্যে একটা অক্ষরজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা যেমন আছে, তেমনই বহু মানুষের এই জ্ঞানটাও নেই যে জরুরি নথি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আবার মুসলমানদের ক্ষেত্রে একেকজনের নামের নানা বানান হয়। সেগুলোকে এখন বদলাতে গেলে সাইবার ক্যাফেগুলোতে ‘ডিজিটাল ব্রোকার বলে একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে – যারা নথি ঠিক করে দেয়ার নাম করে অনেক টাকা দাবি করছে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা।‘

আরেকটি যে শ্রেণির মানুষ আতঙ্কে রয়েছে এসআইআর নিয়ে, তারা হলেন পরিযায়ী শ্রমিক। পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সূত্রে অন্য রাজ্যে থাকেন। তারা বছর এক কি দু’বার হয়ত বাড়িতে ফেরেন।

এখন এসআইআর করার জন্য যদি তাদের আবারও বাড়িতে আসতে হয়, সেটা একটা বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ বলে জানাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক।

তার কথায়, ‘এদের অনেকেরই জন্মের সার্টিফিকেট বা স্কুল পাশের নথি নেই। সেসব কিভাবে জোগাড় করবেন, কিভাবে জমা দেবেন তারা – এটা ভেবে অনেকেই আতঙ্কিত।‘

প্রধান নির্বাচনী কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বলছেন, অন্য রাজ্যে যারা কাজের সূত্রে বসবাস করেন, তারা অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করে জমা দিতে পারবেন।

তবে অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করে জমা দেয়া বা দরকার পড়লে যখন শুনানিতে ডাকা হবে, তখন গ্রামের বাড়িতে হাজির থাকা কতটা বাস্তবসম্মত হবে, তা নিয়ে সন্দিহান আসিফ ফারুক।

সূত্র : বিবিসি