দিল্লিকে আরেকটি বাণিজ্যিক ধাক্কা যুক্তরাষ্ট্রের

ইরানের চাবাহার বন্দরে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের ওপর সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বন্দরে ভারতের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
ইরানের চাবাহার বন্দর
ইরানের চাবাহার বন্দর |বিবিসি

ইরানের চাবাহার বন্দরে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের ওপর সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বন্দরে ভারতের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে।

বন্দরের একটি টার্মিনাল সম্পূর্ণভাবে ভারত পরিচালনা করে থাকে। আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সাথে পণ্য আমদানি- রফতানির জন্য এই বন্দর ভারতের কাছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইরানের দক্ষিণ উপকূলে সিস্তাত-বালুচিস্তান অঞ্চলে অবস্থিত চাবাহার বন্দর ভারত আর ইরান যৌথভাবে গড়ে তুলছে।

কৌশলগত বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ওই বন্দর পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারতকে সাজা দেয়া হলো।

সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী মুখপাত্র থমাস পিগাট এই সংক্রান্ত ঘোষণা করেছেন।

তিনি বলেছেন, চাবাহারে কাজ চালানোর জন্য ২০১৮ সালে কিছু ছাড় দেয়া হয়েছিল, যা এখন প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। ইরানকে একঘরে করার যে কৌশল ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়েছেন, এই ঘোষণা তারই অংশ।

পিগাট জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণ আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইরান ফ্রিডম অ্যান্ড কাউন্টার প্রোলিফারেশন অ্যাক্ট বা আইএফসিএ অনুযায়ী দেয়া কিছু ছাড় এখন প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ’এই সিদ্ধান্ত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হবে। এর পরে যারাই চাবাহার বন্দরে পরিচালনার সাথে যুক্ত থাকবে বা আইএসিএ অনুযায়ী অন্যান্য কাজকর্মে শামিল হবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে।’

ভারতের জন্য ধাক্কা?

যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা ভারতের জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে। কারণ চাবাহার বন্দর প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ভারত। কানেক্টিভিটি ডিপ্লোম্যসির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেও চাবাহার বন্দরকে দেখে থাকে দিল্লি।

ওমান উপসাগরের এই বন্দরটির একটি টার্মিনাল গড়ে তোলার জন্য ভারত ইরানের সাথে হাত মিলিয়েছে। এই বন্দর পরিচালনার জন্য ২০২৪ সালের ১৩ মে ১০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি সই করেছে ভারত। দেশটি ওই বন্দরের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিল। এই প্রথম ভারত বিদেশের কোনো বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল।

মাত্র গত বছর বন্দর পরিচালনার চুক্তি সই হলেও সেই ২০০৩ সালেই চাবাহার বন্দর গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয় ভারত। দিল্লি চেয়েছিল, পাকিস্তানকে এড়িয়ে ভারতীয় পণ্য যাতে সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্র্যান্সপোর্ট করিডোর অর্থাৎ আইএনসিটিসি-র মাধ্যমে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পৌঁছানো যায়।

আইএনসিটিসি প্রায় ৭২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী পরিবহন প্রকল্প। এই পরিবহন পথ দিয়ে ভারত, ইরান, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য চলাচল অনেক সুবিধাজনক হয়েছে।

তবে ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে চাবাহার বন্দরের উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে গেছে।

ভারতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দর?

ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্র্যান্সপোর্ট করিডোর অর্থাৎ আইএনসিটিসি-র জন্য চাবাহার বন্দর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই পথ দিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে ভারতীয় পণ্য। আবার ইরান আর রাশিয়ার জন্যও আইএনসিটিসি যথেষ্ট লাভজনক।

বন্দরটি গড়ে তোলার ব্যাপারে ভারত আর ইরানের মধ্যে সমঝোতা হয় ২০০৩ সালে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৬ সালে ইরান সফর করার সময়ে ওই সমঝোতা অনুমোদন পায়।

এই বন্দর ব্যবহার করে পাকিস্তানকে এড়িয়ে আফগানিস্তান থেকে সরাসরি ভারতে প্রথম বার পণ্য এসেছিল ২০১৯ সালে।

দিল্লিতে জি-টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে একটি নতুন বাণিজ্য-রুট গড়ে তোলার ব্যাপারে যখন ঐকমত্য হয়, তখন থেকে চাবাহার বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল।

বলা হয়েছিল, ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ পণ্য করিডোর গড়ে উঠলে চাবাহার বন্দরের বিশেষ গুরুত্ব থাকবে না। কিন্তু ভারত আর ইরান যখন আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই করল চাবাহার নিয়ে, তখন বোঝা গিয়েছিল যে এই বন্দরটির গুরুত্ব মোটেই কমে যায়নি।

ভারতের ইন্ডিয়ান পোর্টস্ গ্লোবাল লিমিটেড আর ইরানের পোর্ট অ্যান্ড মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের মধ্যে এই চুক্তি হয়। প্রতিবছর পুনর্নবিকরণযোগ্য চুক্তির মাধ্যমে ভারত শাহিদ বেহেশতি টার্মিনাল পরিচালনার ভার নেয়।

যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে চাবাহার বন্দর প্রকল্পকে ইরানের ওপরে জারি করা তাদের নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দিয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল আফগানিস্তানে যাতে ইরানের পেট্রোলিয়াম পণ্য পৌছানো যায়। সেই সময়ে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল।

তবে নতুন ঘোষিত মার্কিন নীতি অনুযায়ী সেই সব ছাড় প্রত্যাহার করে নেয়া হলো।

বিশ্লেষকরা কী বলছেন?

অনেক বিশ্লেষকই আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে চিন্তা ব্যক্ত করেছেন।

কৌশলগত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানি এক্স হান্ডেলে লিখেছেন, ’ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপরে চাপ আরো বাড়াচ্ছে। ভারতীয় পণ্যের ওপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পরে এখন ভারতের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ইরানের চাবাহার বন্দরের ওপরে ২০১৮ সালে নিষেধাজ্ঞায় যে ছাড় দেয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হলো। এই বন্দরটির পরিচালন ভার ভারতের হাতে।’

তিনি বলেন, ’এই বন্দরটি আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার জন্য ভারতীয় পণ্যের প্রবেশদ্বার যেমন, তেমনই পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের জবাবও বটে।’

পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর চীনের সহায়তায় বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনার অংশ।

চেলানি আরো মন্তব্য করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম কার্যকালে জারি করা নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে ইরানের কাছ থেকে তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল ভারত। এর ফলে চীন লাভবান হয়েছে।

ইরানের কাছ থেকে চীন খুবই সস্তায় অপরিশোধিত তেল কেনে আর ইরানের তেলের বলতে গেলে একমাত্র আমদানিকারক হয়ে উঠেছে চীন।

চেলানি বলেন, ওই তেল ব্যবহার করেই চীন তার শক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগলমান লিখেছেন, ’এটা ভারতের জন্য একটা কৌশলগত ধাক্কা। চাবাহার ভারতের কানেক্টিভিটি প্রকল্পগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে না গিয়েও আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় পৌঁছাতে পারে ভারত এই বন্দর দিয়েই।’

সূত্র : বিবিসি