নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন দেশটির প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেপালের ইতিহাসেরও অংশ হলেন তিনি। দেশটিতে চলমান অনিশ্চয়তার মধ্যে, জেন-জি আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী, সুশীলা কার্কিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পৌডেল।
প্রেসিডেন্টের আন্তর্জাতিক-বিষয়ক উপদেষ্টা সুরেশ চন্দ্র চালিসে জানিয়েছেন, ‘প্রেসিডেন্ট সংবিধানের চেতনার ভিত্তিতে সুশীলা কার্কিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন।’
দেশটির শীর্ষ নেতা, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এই শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
নেপালে আন্দোলন-বিক্ষোভের পর, ভার্চুয়াল ভোটের ফলাফলে সুশীলা কার্কিকেই মনোনীত করেছিলের জেন-জি বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভের সময় ১৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পরের দিন, সুশীলা কার্কি বানেশ্বরের বিক্ষোভস্থলে যান এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের সাথেও দেখা করেন।
বিরাটনগরে নেপালি কংগ্রেসের কৈরালা পরিবারের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক পটভূমিতে জন্ম নেয়া কার্কি বিয়ে করেছিলেন নেপালি কংগ্রেসের সাবেক নেতা দুর্গা সুবেদীকে।
কার্কির মতে, একজন আইনজীবী থেকে প্রধান বিচারপতি হওয়ার যাত্রায় তার স্বামীর সমর্থন ও সততা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
তিনি অবশ্য বিতর্ক থেকে মুক্ত নন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে প্রায় ১১ মাসের মেয়াদে অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছিলেন সুশীলা কার্কি নিজেও।
আদালত থেকে সরকার প্রধান
নেপালে বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ৬৫ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হন তিনি। এরপর দেশটির ৭৫ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে, আনুষ্ঠানিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীও (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান) হলেন তিনি।
এমন এক সময়ে তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন, যখন দীর্ঘদিন ধরে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়নি। উচ্চ আদালত গঠনসহ প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হচ্ছিল বিচার বিভাগ। এছাড়াও, সুপ্রিম কোর্টে মামলার জট বেশি থাকা এবং বিচারকের সংখ্যা কম নিয়েও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল বিচার বিভাগ।
এমন নানা কারণে সে সময় তাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছিলেন তার পূর্বসূরিরাও। যদিও কিছু বিতর্ক ছাড়া, তার মেয়াদকাল নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তোলেননি সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন, অপ্রত্যাশিত ও অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তিনিই দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চলেছেন।
নেপালের বিরাটনগরে জন্ম নেয়া ৭৩ বছর বয়সী এই নারী ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। এরপরই যোগ দেন আইন পেশায়। বলা হয়, সেই সময়ে একজন নারীর পক্ষে আইন পড়া ও আইন অনুশীলন করা সাধারণ ঘটনা ছিল না।
বিরাটনগর ও ধরণে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয়ভাবে ওকালতি করার পর তিনি সরাসরি বিচারক হিসেবে প্রবেশ করেন সুপ্রিম কোর্টে। সাবেক প্রধান বিচারপতি রাম প্রসাদ শ্রেষ্ঠা বলেছিলেন, তিনি সুশীলা কার্কির সম্ভাবনা দেখেই তাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে সুপারিশ করেছিলেন।
নেপালের কংগ্রেস নেতা ও দেশটির সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী জেপি গুপ্তকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার পর বিচারক হিসেবে আলোচনায় আসেন সুশীলা কার্কি। বিবিসির সাথে আগের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে তিনি প্রায়শই তার বেঞ্চে দুর্নীতির মামলা শুনানি করেন।
এছাড়া ওই সময় একটি মামলা পুনর্বিবেচনার জন্য সাবেক কমিশন ফর দ্য ইনভেস্টিগেশন অফ অ্যাবিউজ অফ অথরিটি (সিআইএএ)-এর প্রধানের দায়ের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সুশীলা কার্কি। পরে তিন বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাকে বাদ দিয় লোকমান সিং কার্কিকে পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়।
লোকমান সিং কার্কির ওই মামলা পুনর্বিবেচনার জন্য পুনরুজ্জীবিত করতে তার সিদ্ধান্ত সেই সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। ওই সময় বৈষম্যের মাধ্যমে নারীর প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অভিযোগও আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে।
বিতর্ক ও আলোচনা
নেপালের সাবেক ক্ষমতাসীন জোটের (নেপালি কংগ্রেস ও মাওইস্ট সেন্টার) সংসদ সদস্যরা সংসদে সুশীলা কার্কির বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব দাখিল করলে তাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।
তবে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এই অভিশংসন প্রস্তাবকে অকার্যকর ঘোষণা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করেছিলেন সাবেক বিচারপতি চোলেন্দ্র শমসের রানা। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সুযোগ দেয়া এবং বিচারক নিয়োগের সময় নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এছাড়া, খিলরাজ রেগমি প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়, মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান করার বিষয়েও সুশীলা কার্কি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি কল্যাণ শ্রেষ্ঠা তাদের মতামত জানিয়েছিলেন। সেখানে রেগমিকে মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছিলেন তারা।
ওই সময় এ নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল যে বর্তমান প্রধান বিচারপতি নির্বাহী শাখার প্রধান হয়ে গেছেন, যা ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নীতি লঙ্ঘন করে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে আলোচনায় আসার পর, সুশীলা কার্কির আগের এই সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে কিছু ব্যাক্তি এখন তার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে বর্তমান প্রধান বিচারপতির নির্বাহী বিভাগের প্রধান হওয়া এবং অবসর গ্রহণের পর বিক্ষোভকারীদের দাবি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়া এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো বার্তা দেয়ায় নিজের খ্যাতি কিংবা তাকে নিয়ে বিতর্ক, এই দুইয়ের মধ্যে কঠিন পরিস্থিতিতে আশার আলো হিসেবে কাজ করাই এখন সুশীলা কার্কির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি