একটা ঝড় যেন ঘনিয়ে আসছে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে। ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক পথে আলোচনার আলোর নিচেই অন্ধকার হয়ে উঠছে তেলআবিবের যুদ্ধঘণ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পাঁচটি সূত্র বলছে, ইসরাইল খুব শিগগিরই ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা সামরিক হামলার কথা চিন্তা করছে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়াই। এই সময়েই আবার ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের সঙ্গে একটি কূটনৈতিক সমঝোতার বিষয় চূড়ান্ত আলোচনা করছেন।
ইরান এবং আমেরিকার মধ্যে একটি প্রাথমিক বা কাঠামোগত চুক্তির সম্ভাবনা ঘনিয়ে এসেছ, মনে করা হচ্ছে। এ চুক্তিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সংক্রান্ত কিছু শর্ত রয়েছে। কিন্তু এই শর্তগুলো ইসরাইলের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। সেই কারণেই ইসরাইল এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব সহকারে ইরানের ওপর একতরফা হামলার কথা ভাবছে। এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ইসরাইলকে এমন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
এই সম্ভাব্য সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে হোয়াইট হাউস এখন পর্যন্ত সিনিয়র কংগ্রেস সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন এরই মধ্যে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান কিংবা অন্যান্য হামলার পরিসীমার মধ্যে পড়ে এমন অঞ্চলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসগুলোকে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছে। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপের দূতাবাসগুলোর জন্য এই সতর্কতা জারি হয়েছে। পাশাপাশি, ইসরাইল যদি হামলা চালায়, তবে ইরানের পাল্টা আঘাতে মার্কিন সেনা ও সম্পদের ওপর আক্রমণ হতে পারে—এমন আশঙ্কাও ক্রমশ জোরাল হচ্ছে।
যদিও ইসরাইল বহু ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার ওপর নির্ভর করে, তবে এই পরিস্থিতিতে তারা হয়তো একাই হামলা চালানোর ক্ষমতা রাখে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মার্কিন এক সূত্র।
তবে, এখন পর্যন্ত সরাসরি হামলার বিষয়ই হোক কিংবা আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহ বা গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করাই হোক না কোনও বিষয়ই মার্কিন সম্পৃক্ততার কোনো প্রকাশ্য পরিকল্পনায় ইসরাইলের নেই বলেই মার্কিন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে।
এর মধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ‘অপ্রয়োজনীয় কর্মচারীদের’ স্বেচ্ছায় ফিরে নির্দেশ দিয়েছে। এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যপ্রাচ্য অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’-এর অধীন বিভিন্ন ঘাঁটি থেকেও সেনা-সদস্যদের পরিবারদের চলে যেতে বলা হয়েছে।
‘সেন্টকম’ কমান্ডার জেনারেল এরিক কুরিলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু বুধবার রাতেই কোনও কারণ ছাড়াই সেই শুনানি স্থগিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, কুরিলা ইসরাইল বিষয়ক এই নতুন পরিস্থিতির দিকেই মনোনিবেশ করছেন।
এ সময় ইরানের ওপর ইসরাইলের হামলার একটি বড় কারণ হতে পারে ইরানের নতুন করে তাদের কৌশলগত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। অক্টোবর মাসে ইসরাইল প্রায় সবকটি ইরানি আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম, বিশেষত এস-৩০০ ধ্বংস করেছিল, তেলআবিবের দাবি। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল রাডার বা সহজে পুনর্গঠনের মতো অংশগুলোতে। ফলে, খুব শিগগিরই ইসরাইলি বিমানচালকদের জন্য ইরানের আকাশে এই ধরণের হামলা অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এখনো পর্যন্ত তারা তুলনামূলক নিরাপদ 'বাতায়নের'-এর মধ্যে রয়েছে।
যদিও ইসরাইল সবসময় মার্কিন সামরিক এবং গোয়েন্দা সহায়তা পছন্দ ও উপভোগ করে, বিশেষত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার জন্য, তবুও তেলআবিব অক্টোবরেই প্রমাণ করেছে, ইসরাইল একাও অনেক কিছু করতে পারে। ইহুদিবাদী যুদ্ধবাজদের পক্ষ থেকে এমন দাবি তোলা হলেও তার সত্যতা যাচাই করা সহজ নয়।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির মাইকেল নাইটস বলছেন, ইরাকে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে অপ্রয়োজনীয় কর্মীদের সরিয়ে নেওয়া তেহরানকে এই বার্তা দিচ্ছে, ট্রাম্প ইসরাইলকে থামাতে আগ্রহী নাও হতে পারেন। “এটা হচ্ছে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছাকে ইরান যেন সম্মান করে—সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা,” বলেন নাইটস। ইরানের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করা হয়।
ট্রাম্প প্রশাসন আগে থেকেই তেহরানকে দু’মাস সময় দিয়েছিল চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু সেই সময়সীমা পার হলেও এখনও ইরান কোনও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েছেন। ট্রাম্পের অভিযোগ, “ইরান এমন সব দাবি তুলছে যা আদৌ মানা সম্ভব নয়। পরমাণু কর্মসূচির বিষয় তেহরান ছাড় দিতে চায় না। ইরানের একটাই লক্ষ্য—ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ। আর সেটা ওয়াশিংটন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
তবে, ইসরাইল এখনই সীমিত পরিসরে হামলা চালাবে, নাকি আরও কিছুটা সময় নিয়ে পরবর্তী আলোচনার গতি দেখবে—সেই সিদ্ধান্ত এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন নাইটস ও একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র।
যুদ্ধ কি সত্যিই আসন্ন? শান্তির টেবিলের নিচে কি লুকিয়ে রয়েছে বিস্ফোরক? ইসরাইলের মুখোমুখি হচ্ছে এক বড় সিদ্ধান্ত—তারা কি ট্রাম্পের কূটনীতি উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবে, নাকি অপেক্ষা করবে আরও কিছুটা সময়? আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—তারা কি শেষ মুহূর্তে জড়িয়ে পড়বে এই সংঘাতে, নাকি ইসরাইলকে একা পথে হাঁটতে দেবে? বিশ্ব কেবল অপেক্ষা করছে, সেই অঘোষিত সকালে—যেদিন তেহরানের আকাশে হঠাৎ গর্জে উঠতে পারে যুদ্ধবিমান।