গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় চলছে। এখন সেখানে কোনো খাদ্য নেই, ওষুধ নেই, নেই প্রকৃত মানবিক সহায়তা—এমন ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সহায়তাকারী সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ)-এর উপ-মেডিক্যাল কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ আবু মুগাইসিব।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থ আনাদোলু এজেন্সিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন , 'এখন এটি আর শুধু বিপর্যয় নয়, বিপর্যয় শব্দটিই এখন খুব ছোট মনে হয়। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি চলছে গাজায়।'
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর নেই
তিনি জানান, টানা ২২ মাসের ইসরাইলি বোমাবর্ষণে গাজার স্বাস্থ্য খাত ধ্বংস হয়ে গেছে। বেশিরভাগ হাসপাতাল ভেঙে পড়েছে বা অচল হয়ে গেছে। 'এখন আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলা যাবে না, বরং গাজায় আর কোনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই,' বলেন তিনি।
যে অল্প কিছু ফিল্ড ক্লিনিক ও অস্থায়ী ওয়ার্ড চালু আছে, সেগুলোতে আহত ও সংকটাপন্ন রোগীর ভিড়ে জায়গা নেই। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, হাসপাতালের বেড দখল হয়েছে ৩০০ শতাংশ হারে। রোগীদের মেঝেতে শুতে হচ্ছে, আর অনেক অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে গেছে ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ঘাটতির কারণে। বর্তমানে ৩৮টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৫টি আংশিকভাবে চালু আছে, সেগুলোর বেশিরভাগই গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
দুর্ভিক্ষ ও ওষুধের ঘাটতি
আবু মুগাইসিব বলেন, সাম্প্রতিক কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকলেও সেগুলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে কার্যকর হয়নি।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন,' এখানে খাবার নেই, ওষুধ নেই, কোনো প্রকৃত মানবিক সাহায্যও নেই,
তিনি আরো বলেন, 'যেসব শিশু অনাহারে মারা যাচ্ছে, তাদের অনেকের শরীরে আগের অসুখ ছিল। চিকিৎসা হলে তারা মারা যেত না। শুধু খাবার পেলেই বাঁচতে পারত। বিশেষ প্রোটিন ও দুধ পেলেই বাঁচতে পারত।'
জাতিসংঘ সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা জরিপে ইতোমধ্যে গাজার উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষের চিত্র উঠে এসেছে। সেপ্টেম্বরে এর প্রভাব দক্ষিণ গাজায়ও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
‘মৃত্যু বিতরণ কেন্দ্র’
তিনি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন বলেন, 'এগুলো বিতরণ কেন্দ্র নয়, বরং মৃত্যুর বিতরণ কেন্দ্র। কারণ এখানে সাহায্য নিতে আসা সাধারণ মানুষকে প্রায়ই আক্রমণ করা হয়।'
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুধু গত মে মাস থেকে সাহায্যের জন্য অপেক্ষার সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি।
পুনর্দখলের পরিকল্পনা ‘পাগলামি’
ইসরাইলের গাজা সিটি পুনর্দখলের পরিকল্পনা নিয়ে আবু মুগাইসিব বলেন, প্রায় ২০ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিকে গাজার এক কোণে ঠেলে দেওয়ার মানে হলো ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ডেকে আনা।
তিনি বলেন, 'এটি একটি পাগলামী পরিকল্পনা। এতে অনেক মানুষ মারা যাবে, নিরীহ মানুষ রক্তাক্ত হবে। তারা বলছে মানবিক অঞ্চল তৈরি করবে , কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু নেই এখানে। দুই মিলিয়ন মানুষকে কোথায় রাখা হবে? কীভাবে তাদের জন্য তাঁবু, স্বাস্থ্যসেবা ও খাবার দেওয়া হবে? এটা আসলেই পাগলামি।'
শুক্রবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল ক্যাটজ নিশ্চিত করেছেন যে, গাজা সিটি দখলের সামরিক পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি মূলত গোটা গাজা পুনর্দখল ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ বাহিনীকে নিরস্ত্র করার বৃহত্তর কৌশলের অংশ।
ইসরাইলি হামলায় ভয়াবহ প্রাণহানি
২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় ৬২ হাজার ৬০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো গাজা উপত্যকা, যা এখন দুর্ভিক্ষে জর্জরিত।
উল্লেখ্য, গত নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা চলছে।