ইরান-আমেরিকা পরমাণু আলোচনায় নতুন মোড়!

ওমান নতুন প্রস্তাব দিয়েছে, কেন এই চুক্তি ট্রাম্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের জন্য এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হোয়াইট হাউসের তিনটি প্রধান বৈদেশিক নীতিসংক্রান্ত সমস্যা হলো ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা যুদ্ধ এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র |সংগৃহীত

ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হামশাহরি অনলাইন রাজনৈতিক ডেস্কের খবরে বলা হয়েছে, তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পরোক্ষ পরমাণু আলোচনার বিষয়টি আবারো নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। ষষ্ঠ দফা আলোচনার প্রস্তুতির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর, পশ্চিমা মিডিয়ায় পরমাণু আলোচনার প্রকৃতি, সম্ভাব্য সমঝোতা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলাপচারিতা এবং জল্পনা-কল্পনা বেড়েই চলেছে।

ডয়চে ভেলের দাবি, দু’পক্ষের মধ্যে ‘আন্তর্বর্তী চুক্তির’ আলোচনা চলছে। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে সম্প্রতি প্রশ্ন তোলে, নতুন একটি চুক্তি কি আসন্ন? সংবাদ মাধ্যমটি দাবি করে, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ‘আন্তর্বর্তী পরমাণু চুক্তি’ নিয়ে আলোচনা চলছে। যদিও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র স্পষ্ট করে বলেছেন, আন্তর্বর্তী চুক্তির বিষয় দু’পক্ষের আলোচ্য সূচিতে নেই।

ডয়চে ভেলের মতে, উপসাগরীয় অঞ্চলের কিছু দেশ, বিশেষত ওমান, এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এমনকি ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আল-বুসাইদি এই অন্তর্বর্তী চুক্তির একটি খসড়া প্রস্তাবও দিয়েছেন বলে গুজব শোনা যাচ্ছে।

ট্রাম্পের জন্য চুক্তির গুরুত্ব অপরসীম। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য নীতিবিষয়ক সহকারী অধ্যাপক সিনা আজোদি বলেন, বর্তমান আলোচনাকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র-দুই পক্ষই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে। তারা চুক্তি করতে চায়। আজোদি ব্যাখ্যা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের জন্য এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হোয়াইট হাউসের তিনটি প্রধান বৈদেশিক নীতিসংক্রান্ত সমস্যা হলো ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা যুদ্ধ এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। তার মতে, ইরানের সাথে একটি চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের, বিশেষ করে ট্রাম্পের, পররাষ্ট্রনীতির বড় সফলতা হিসেবে বিবেচিত হবে।

ইসরাইলের হুমকি এবং সময়সীমা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ডয়চে ভেলের সাথে সাক্ষাৎকারে আজোদি আরো উল্লেখ করেন, ইসরাইল সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে যেসব হুমকি দিচ্ছে, সেগুলো আলোচনার সময়সীমা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করছে। কারণ, ‘স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম’ এর মেয়াদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এই ব্যবস্থাটি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২০১৫ সালের পরমাণু সমঝোতা জেসিপিওর আওতায় যুক্ত ছিল। এ মোতাবেক প্রয়োজনে পূর্বের নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনরায় কার্যকর করতে পারে।

আজোদি বলেন, ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া ইরানে আক্রমণ করবে না। অনেকে মনে করেন, যতদিন আলোচনা চলছে, ততদিন এমন একটি হামলার আশংকা কম।

আলোচনার প্রকৃতি এবং পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্রশ্নে দ্বন্দ্ব রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম চার দফার আলোচনায় তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এর মূল কারণ হলো ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বিষয়েও একমত হতে পারেনি। ইরান বলছে, তারা বেসামরিক উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, এই প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বন্ধ করা হোক। এ অবস্থায় ওমান একটি আন্তর্বর্তী চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে প্রাথমিকভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ আংশিকভাবে স্থগিত থাকবে এবং তার বদলে কিছু নিষেধাজ্ঞা আংশিকভাবে প্রত্যাহার করা হবে।

বিকল্প সমাধান হিসেবে পারস্য উপসাগরীয় কনসোর্টিয়ামের কথা ভাবা হচ্ছে। ডয়চে ভেলে আরো জানায়, আলোচনার একটি সম্ভাব্য বিকল্প সমাধান হতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর একটি যৌথ কনসোর্টিয়াম গঠন, যেখানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থাকবে। এই প্রস্তাবের লক্ষ্য হলো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে আরো ‘স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ করে তোলা। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের অনুগত পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য ‘স্বচ্ছ’ নয়। আজোদি আরো বলেন, এই অঞ্চলে যেন আরেকটি যুদ্ধ না বাধে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের জন্যই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যারা চান, তাদের জন্য নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।

২০১৯ সালের উদাহরণ হিসেবে সৌদি তেল কোম্পানি আরামকোতে হাউছিদের হামলার কথাও বলা হয়েছে। আজোদি বলেন, ২০১৯ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যখন যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক তলানিতে, তখন ইয়েমেনের হাউছি বিদ্রোহীরা সৌদি রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকো-তে হামলা চালায়। রিয়াদ তখন আশা করেছিল, তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র শক্ত প্রতিক্রিয়া জানাবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। এরপর থেকেই সৌদি আরব বুঝতে পারে, ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন হয়তো কৌশলগতভাবে আরো লাভজনক হতে পারে। সেই থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক পরিবর্তনের পথে হাঁটছে। ইরান-সৌদি সম্পর্কে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি রিয়াদ সফর করেন এবং যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে বৈঠক করেন।

২০২৫ সালের এপ্রিলে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান তেহরান সফর করেন। সে সময় তিনি ইরানে রাহবার হিসেবে পরিচিত সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সাথেও বৈঠক করেন। দীর্ঘদিনের শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে এই দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক শক্তি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে হাঁটছে। এমনকি তারা সামরিক সহযোগিতা নিয়েও সমঝোতায় পৌঁছেছে।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার পরমাণু আলোচনা নতুন করে গতি পাচ্ছে। পারস্য উপসাগরের ভূরাজনীতির পরিবর্তন, সৌদি-ইরান সম্পর্কের উষ্ণতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের রাজনৈতিক কৌশল সবকিছু মিলে একটি সম্ভাব্য ‘আন্তর্বর্তী চুক্তি’কে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসছে। এখন দেখার বিষয়, এই আলোচনায় কতটা বাস্তব অগ্রগতি হয় এবং এটি ভবিষ্যৎ বিশ্বরাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।