অধিকৃত পশ্চিমতীরে বসতি নির্মাণের এক বিতর্কিত পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন ইসরাইলের কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ। তবে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ফিলিস্তিনের অধিবাসী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ইসরাইলের এই পরিকল্পনা ভূখণ্ডটিকে দুইভাগে বিভক্ত করে ফেলবে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) স্মোত্রিচ বলেন, পশ্চিমতীরে বিতর্কিত একটি বসতি স্থাপন প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজারের বেশি বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ এই পরিকল্পনা অনুমোদন পেতে পারে বলে জানান তিনি।
এমন একটি সময়ে ইসরাইলি অর্থমন্ত্রী এই পরিকল্পনার কথা সামনে আনলেন, যখন অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
স্মোত্রিচ বলেন, তাদের প্রকল্পটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে পারে।
বিতর্কিত দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা
আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র বিরোধিতার মুখে প্রায় দুই দশক ধরে পূর্ব জেরুসালেম তথাকথিত ‘ই-ওয়ান’ প্রকল্পের কাজ স্থগিত রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমতীরের রামাল্লাহ ও বেথেলহেমের সংযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
শহর দুটির মধ্যে আকাশপথে দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। তবে ই-ওয়ান প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই দুই শহরের বাসিন্দারা সরাসরি যাতায়াতের সুযোগ হারাবেন। তখন একাধিক চেক পয়েন্ট অতিক্রম করে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে হবে। এতে যাত্রাপথে কয়েক ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় লেগে যাবে।
স্মোত্রিচ বলেন, ‘প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণার কবর রচনা হবে। কারণ, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মতো কিছুই নেই এবং স্বীকৃতি দেয়ার মতোও কেউ নেই।’
যদি কেউ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় তাহলে এই ভূমি থেকে তাদের জবাব দেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তবে বৃহস্পতিবারের ঘোষণার পর এই পরিকল্পনা নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। অবশ্য এর আগে এই ধরনের পরিকল্পনার প্রশংসা করেছিলেন তিনি।
এদিকে, বাইডেন প্রশাসনের চাপে মুখে ই-ওয়ান প্রকল্প স্থগিত থাকলেও বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলে তার দূত মাইক হুকাবির প্রশংসা করেন স্মোত্রিচ। তিনি বলেন, তারা ইসরাইলের প্রকৃত বন্ধু, এমন তারা আর কখনো পায়নি।
ফিলিস্তিনি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিন্দা
আগামী ২০ আগস্ট এই বসতি নির্মাণের পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে পারে। যদিও কিছু প্রশাসনিক ধাপ এখনো বাকি আছে, তবে প্রক্রিয়া দ্রুত এগোলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হতে পারে এবং প্রায় এক বছরের মধ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণ শুরু হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এই বসতির বিরোধিতাকারী প্রতিষ্ঠান পিস নাউ জানিয়েছে, এখানে বসতি নির্মাণের বিরোধী মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীদের সব আবেদন গত ৬ আগস্ট খারিজ করেছে পরিকল্পনা কমিটি। এই পরিকল্পনার অনুমোদনকে উপনিবেশবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও বর্ণবাদাী আখ্যা দিয়েছেন ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আহমেদ আল-দিক।
তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে ইসরাইলি সরকারের পরিকল্পনার অংশ। এর মাধ্যমে তারা পশ্চিমতীরকে বিভক্ত করে দক্ষিণ অংশ থেকে উত্তর ও মধ্য অংশ থেকে আলাদা করতে চায়।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এটি দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে অন্যতম বাধা এবং এর ফলে এই অঞ্চলে আরো বহু বছর ধরে রক্তপাত অব্যাহত থাকবে বলে সতর্ক করে পিস নাউ।
এদিকে, নেতানিয়াহুর বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার সমালোচনা করেছেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও আরব দেশগুলো। যদিও এ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি তিনি। তবে কেউ মনে করছেন এখানে পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আবার অনেকের ধারণা, বাইবেলে বর্ণিত সীমানা অনুযায়ী জর্ডান ও লেবাননের মতো অন্যান্য আরব দেশের অংশও এই বৃহত্তর ইসরাইলের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও এ ঘোষণার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি ইসরাইলি সরকারকে সব ধরনের বসতি নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র স্তেফান দুজারিচ।
দুজারিচ বলেন, ই-ওয়ান প্রকল্পের অগ্রগতি হলে এটি পশ্চিমতীরকে বিভক্ত করে ফেলবে। এতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ব্যাহত হবে।
কঠোর বাস্তবতা
ইসরাইলিদের এই বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা প্রতিনিয়তই ফিলিস্তিনিদের জন্য কঠোর বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর বসতিস্থাপনকারীদের হামলা, ফিলিস্তিনি শহর থেকে তাদের উচ্ছেদ, জায়গায় জায়গায় ইসরাইলি চেকপয়েন্টসহ ফিলিস্তিনি হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বর্তমানে সাত লাখেরও বেশি ইসরাইলি অধিকৃত পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুসালেমে বসবাস করছেন।
১৯৬৭ সালে এই অঞ্চলগুলো দখল করে ইসরাইল। তবে এসব এলাকাকে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দাবি করে ফিলিস্তিনিরা। এই এলাকাগুলোতে ইসরাইলি বসতি নির্মাণ অবৈধ এবং শান্তির পথে প্রধান অন্তরায় বলে দাবি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। তবে এসব অমান্য করে পশ্চিমতীরে বসতি দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করছেন ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী।
১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গাজা উপত্যকা দখল করে ইসরাইল। এই তিনটি ভূখণ্ডই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ বলে দাবি করেন ফিলিস্তিনিরা।
এর মধ্যে পূর্ব জেরুসালেমকে নিজেদের রাজধানীর অংশ বলে দাবি করে ইসরাইল। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এটি স্বীকৃত নয়। ২০০৫ সালে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করলেও পশ্চিমতীর আজও একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড হিসেবে রয়ে গেছে।
সূত্র : ইউএনবি