কাতারে ইসরাইলি হামলা নাড়িয়ে দিলো বিশ্ব বিবেক

ইসরাইলের সামরিক সুবিধা স্পষ্ট। তারপরও নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ফিলিস্তিনি জনগণ, বিশ্বের রাস্তাঘাট, গ্লোবাল সাউথ এবং আরব কূটনীতি একসাথে উপেক্ষা করা যায় না।

নয়া দিগন্ত অনলাইন

বিশ্বের প্রতিটি দেশের রাস্তা এখন মানুষের দখলে। তারা গাজায় ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। সিউল থেকে সাও পাওলো, নয়াদিল্লি থেকে ঢাকার সব দেশ গাজার সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। তাদের কণ্ঠস্বর যেন মহাদেশজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

নাগরিকরা আর নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক নন। তারা মিছিল-স্লোগানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার দাবি করেন। গাজার অবরোধ এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বোমাবর্ষণ, অনাহার এবং অবরোধের মুখে থাকা জনগণ এখনো অটল। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এখন কোথাও যাবে না। তাদের এই প্রতিরোধ বিশ্বব্যাপী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী চাইলেও তা মুছে ফেলতে পারবে না।

এই সঙ্কটে কাতার গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মানবিক এবং ভূ-রাজনৈতিক উভয় দিক বিবেচনা করে দোহা কৌশলগত ভূমিকা পরিচালনা করছে। তারা গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করে, অবকাঠামো মেরামতের জন্য অর্থায়ন করে, অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি আলোচনা করে এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিকে প্রভাবিত করার জন্য তার কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে। কাতারের অংশগ্রহণ স্মরণ করিয়ে দেয় যে ছোট রাষ্ট্রগুলো দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করার মাধ্যমে সামরিকভাবে প্রভাবশালী শক্তিশালী ও ধনী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

কাতারের উপর ইসরাইলের হামলা কেবল একটি দেশের উপর আক্রমণ ছিল না। বরং এটি একটি ঘোষণা ছিল যে কোনো আইন তার দায়মুক্তিকে বাধা দেয় না।

আরব লীগ, তার ঐতিহাসিক সকল বিভাজনের পরেও গাজার জন্য অনেক দিক থেকে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেন নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও গাজার উপর হামলার ফলে কায়রো, রিয়াদ, আম্মান এবং তার বাইরেও ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর তৈরি হয়েছে।

ইসরাইলের বোমাবর্ষণ নিয়ে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। পর্দার আড়ালের কূটনীতির মাধ্যমে ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস ও জাতিসঙ্ঘের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে জরুরি মানবিক পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে। আরব বসন্তের ধারা এখন বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। আরব রাষ্ট্রের সরকার জানে যে রাস্তাগুলো উপেক্ষা করা যাবে না। এই সচেতনতা সমন্বিত পদক্ষেপকে উৎসাহিত করেছে, অন্তত কূটনৈতিকভাবে এবং দীর্ঘদিন ধরে সুপ্ত আরব সংহতির অনুভূতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।

আরব বিশ্বের রাস্তাগুলো আবারো রাজনৈতিক অভিনেতার মতো কাজ করছে। কায়রো থেকে আম্মান, তিউনিস থেকে রাবাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ নিন্দা জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা মনে করছে আরব সরকারগুলো গাজায় ইসরাইলের আক্রমণ এবং নীরবতার সাথে জড়িত ।

তাদের এই বিক্ষোভগুলো একদিকে আরব বসন্তের স্মৃতি বহন করে। অন্যদিকে তীক্ষ্ণ নৈতিক ধারণাও প্রদান করে। মানুষ কেবল ফিলিস্তিনিদের জন্য মর্যাদা ও ন্যায়বিচার দাবি করছে না। বরং তাদের নিজেদের সরকারের দেউলিয়াত্বও প্রকাশ করছে।

ইউরোপের প্রতিক্রিয়াও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। গাজার প্রতিরক্ষায় ইউরোপের নগর কেন্দ্রগুলোতে অভূতপূর্ব সমাবেশ দেখা যাচ্ছে। প্যারিস, বার্লিন, লন্ডন, মাদ্রিদ ও রোমের রাস্তাগুলো এখন বয়স, ধর্ম ও রাজনৈতিক সীমা অতিক্রমকারী বিক্ষোভকারীদের দ্বারা প্লাবিত। এই বিক্ষোভগুলো প্রতীকী নয়। বরং এগুলো জবাবদিহিতার দাবি এবং জড়িত থাকা অস্ত্র চুক্তির সমালোচনা। যেগুলো ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইলের সামরিক যন্ত্রকে ইন্ধন জুগিয়েছে।

সরকারগুলো তাদের জনগণের নৈতিক ও নাগরিক দাবির সাথে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের সমন্বয় সাধনের জন্য চাপের মধ্যে রয়েছে। উত্তর আমেরিকায়ও একই ধরণের স্রোত দেখা দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয়, শহরের স্কোয়ার এবং পাবলিক ফোরামগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে ফিলিস্তিনি সংহতির প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠছে। রাজনীতিবিদ এবং কর্পোরেশনগুলোকে একইভাবে চ্যালেঞ্জ করছে।

নৈতিকতা বিবেচনায় গ্লোবাল সাউথ নিজেকে নির্ধারক শক্তি হিসেবে তুলে ধরছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ এবং নাগরিক প্রচারণা দেখা গেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও ফিলিস্তিনি সংহতির প্রসার প্রদর্শন করছে।

দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান প্রায়ই রাজনৈতিকভাবে সতর্ক হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে ছাত্র, কর্মী এবং সাধারণ নাগরিকদের গাজার পক্ষে সমাবেশ করতে দেখা গেছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া এবং নাইজেরিয়ায় নাগরিক সমাজ সংগঠন, ইউনিয়ন এবং ছাত্র গোষ্ঠী পশ্চিমাদের জড়িত থাকার সমালোচনা করে।

ল্যাটিন আমেরিকা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও মেক্সিকোসহ অন্যান্য দেশ প্রতিরোধের নেটওয়ার্ক তৈরি করে। তারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সমালোচনা এবং মানবাধিকাররে কথা তুলে ধরে। সিউল থেকে সাও পাওলো পর্যন্ত একই স্লোগান, ‘প্যালেস্টাইন মুক্ত করুন, অবরোধের অবসান ঘটান।’

ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ সামাজিক কাঠামোতে টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলমান সামরিকবাদ, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা তাদের পারিবারিক জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সরকারের আগ্রাসী নীতিতে অস্বস্তিতে থাকা ইহুদি জনগোষ্ঠী দেশত্যাগ করছে অথবা প্রকাশ্যে ভিন্নমত পোষণ করছে।

অভ্যন্তরীণ উত্তেজনাগুলো তাদের নৈতিক ও ব্যবহারিক উভয় সীমাবদ্ধতার সাথে লড়াই করছে। অর্থনৈতিকভাবে, ইসরাইল আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, বিচ্ছিন্নতা অভিযান এবং দীর্ঘস্থায়ী সঙ্ঘাতের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তারা। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং রাষ্ট্রীয় বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে।

আরব বসন্তের প্রতিধ্বনি বর্তমান আন্দোলনগুলোতে স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে সরকারগুলো জনসাধারণের অনুভূতি উপেক্ষা করতে পারে না। তিউনিসিয়া থেকে মিসর, জর্ডান পর্যন্ত নাগরিক বিক্ষোভ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণা গাজার সংগ্রামকে আরো জোরদার করে।

ইউরোপের শ্রমিক ইউনিয়ন, শিল্পী এবং শিক্ষাবিদরা ক্রমবর্ধমানভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে তুলে ধরছেন। ইসরাইলের সাথে অস্ত্র রফতানি এবং বাণিজ্য চুক্তি পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। উত্তর আমেরিকায়, ফিলিস্তিনি সংহতি আন্দোলন কেবল ক্যাম্পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং তারা কর্পোরেট বোর্ড, সিটি কাউন্সিল এবং আইনসভার শুনানিতেও প্রকাশ করছে।

গাজায় ধ্বংস ও অভাবের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের ধৈর্য বিশ্বব্যাপী জাগরণকে অনুপ্রাণিত করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা, আন্তর্জাতিক আইনি সমর্থন ও স্থিতিস্থাপকতা কোটি কোটি মানুষের নৈতিক কল্পনাকে শক্তিশালী করে। ফিলিস্তিনিরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়; বরং স্বীকৃতি, ন্যায়বিচার ও সার্বভৌমত্বের উপর জোর দেয়। তাদের বার্তা মহাদেশজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়।

কাতারের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ একটি অস্থির আঞ্চলিক ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে।

ইসরাইল এখন দ্বৈত সঙ্কটের মুখোমুখি। একদিকে গাজায় কর্মক্ষম আধিপত্য। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিধিত্ব। এর অভ্যন্তরীণ সামাজিক সংহতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। পাশাপাশি নৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে।

গাজা কেবল অবরুদ্ধ ভৌগোলিক স্থান নয়। এটি বিশ্বব্যাপী নৈতিক জাগরণের কেন্দ্রস্থল। ফিলিস্তিনিরা অটল স্পষ্টতার সাথে ঘোষণা করে, ‘আমরা এখানে আছি। আমরা বেঁচে আছি। আমরা কোথাও যাচ্ছি না।’

ইসরাইলের সামরিক সুবিধা স্পষ্ট। তারপরও নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ফিলিস্তিনি জনগণ, বিশ্বের রাস্তাঘাট, গ্লোবাল সাউথ এবং আরব কূটনীতি একসাথে উপেক্ষা করা যায় না।

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ছামিয়া আক্তারের অনুবাদ